সরকার নির্ধারিত দরে ব্যাংকের কথাও ডলার বিক্রি করছে। সরকার নির্ধারিত ৮৪.৬৫ টাকার ডলার বিভিন্ন ব্যাংকে বিনিময় হচ্ছে ৮৬.৫০ টাকা দরে। তাই কার্ব মার্কেটেও ডলার বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। দেশের ইতিহাসে ডলারের এত চড়া দাম এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের আমদানি বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের আমদানি মূল্য। যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের কয়েকজন আমদানিকারক গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন, ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ডলারের দাম। সরকার ডলার প্রতি ৮৪.৬৫ টাকা বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিলেও কোনো ব্যাংকই এই দর মানছে না। বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে দর নির্ধারণ করে মুদ্রা বিনিময় করছে। কোন কোন ব্যাংক গতকাল সপ্তাহের প্রথম দিনে ৮৬.৫০ টাকা দরে ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করে লেনদেন সম্পন্ন করেছে। এতে আমদানিকারকেরা অস্বাভাবিক চাপে পড়ে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করে ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রতিটি আমদানি পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি নির্ভর একটি দেশ হিসেবে যা বাংলাদেশের সার্বিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অবশ্য কোন কোন ব্যাংক সরকার নির্ধারিত রেটের ধারে কাছে বিনিময় করছে। ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি অসম প্রতিযোগিতাও তৈরি হচ্ছে বলে উল্লেখ করে একজন আমদানিকারক বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাঝে একটি সুষ্ঠু বিনিময় হার প্রচলিত থাকলে সুবিধা হতো। কোনো ব্যাংক ৮৫ টাকা কোনো ব্যাংক ৮৬ টাকা আবার কোনো ব্যাংক ৮৬.৫০ টাকা দরে ডলার বিক্রি করায় একই ধরনের পণ্যের আমদানি মূল্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। একজন আমদানিকারক সরকারি ব্যাংক থেকে এলসি করলে তিনি মূল্য পরিশোধ করছেন ৮৪.৬৫ টাকা দরে, আবার একই পণ্য যখন বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে আনা হচ্ছে তখন মূল্য হিসেব করা হচ্ছে ৮৬ টাকা দরে। ফলে পণ্যের আমদানি ব্যয় এবং বাজার মূল্যে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। যা ব্যবসায়ীদের নতুন সংকটে ফেলবে বলেও তারা উল্লেখ করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিন কোটি কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করছে। এই কোটি কোটি ডলারের বাড়তি মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের আমদানিকারকদের শত শত কোটি টাকা বাড়তি যোগান দিতে হচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান এভাবে কমে যাওয়ার পেছনে ডলারের যোগান কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলেছেন, আমাদের রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। এতে করে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টের কারেন্ট একাউন্টে’ ঘাটতি বেড়ে গেছে। আর এই ঘাটতি বাড়ার সাথে সাথে ডলারের দাম বাড়ছে।
তিনি বলেন, এক কোটি ডলারের কোন চালানে এভাবে ডলার প্রতি এক টাকা দেড় টাকা কম বেশির ফলে এক দেড় কোটি টাকা পার্থক্য হয়ে যায়। একটি চালান থেকে এক দেড় কোটি টাকা ব্যবসা করা কঠিন একটি ব্যাপার বলেও তারা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, প্রতিটি ব্যাংক যদি একই রেটে ডলার বিনিময় না করে তাহলে এই সংকটের সুরাহা হবে না।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল একাধিক অর্থনীতিবিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ডলার নিয়ে পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগের। ডলারের বিপরীতে এভাবে টাকার দাম কমে যাওয়া কোন ভাল লক্ষণ নয়। তারা বলেন, দেশ থেকে প্রচুর ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। কার্ব মার্কেট থেকেও প্রচুর ডলার কেনা হচ্ছে। আমদানি বাণিজ্যের স্বাভাবিক লেনদেনের বাইরেও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর ডলার পাচার করা হচ্ছে। এতে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ডলারের ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ বলেন, আমদানি এবং রপ্তানি বাণিজ্যে একটি বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এতে ডলারের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে। সব কিছুর মূলে ওভার ইনভয়েসিংয়ের নামে মুদ্রা পাচার করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, শক্ত হাতে ওভার ইনভয়েসিং বন্ধ করা না গেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে।
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার ৮৪.৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তা মানা হচ্ছে না। এটি নতুন করে সংকট তৈরি করছে। আবার ব্যাংকগুলো এই দর মানতে পারছে না। কারণ এই দরে ব্যাংক ডলার কিনতে পারছে না। ব্যাংকগুলোকে চড়া দরে ডলার কিনে আমদানি বাণিজ্যে যোগান দিতে হচ্ছে। ফলে তাকে বাড়তি দরে বিনিময় করতে হচ্ছে। এটিও নতুন করে সংকটের তৈরি করবে।
কার্ব মার্কেটে প্রচুর ডলার চলে যাচ্ছে উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংকের সাথে কার্ব মার্কেটের পার্থক্যও অনেক। কার্ব মার্কেটে ডলারের চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। একটি মহল কার্ব মার্কেট থেকে কোটি কোটি টাকার ডলার কিনে নিচ্ছে। অপরদিকে ব্যাংকে দর ভালো থাকায় বিদেশ থেকে ডলার আর কার্ব মার্কেটে আগের মতো আসছে না। ফলে ডলারের একটি সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটকে পুঁজি করেও কার্ব মার্কেটে বাড়তি দরে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
ডলার নিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেল বা কার্ব মার্কেটে বিদ্যমান সংকট শক্ত হাতে মোকাবেলা করা না গেলে বাজার পরিস্থিতিও অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে। যার নেতিবাচক প্রভাব প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থায় পড়বে বলেও অর্থনীতিবিদেরা মন্তব্য করেছেন।
লাফিয়ে লাফিয়ে ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ার অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ইস্ট ডেল্টা ইউনির্ভাসিটির উপাচার্য প্রফেসর মু. সিকান্দর খান দৈনিক আজাদীকে বলেন, বহুদিন ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের প্রস্তাব করা হচ্ছিল। এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের সময় এসেছে। টাকার অবমূল্যায়ন করলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যেত। এতে আমদানি কিছুটা হ্রাস পেত। আর আমদানি হ্রাস পেলে ডলারের যেই ভারসাম্যহীনতা তা কমে আসত বলেও তিনি উল্লেখ করেন। একই সাথে টাকার অবমূল্যায়নে বিদেশে আমাদের তৈরি পোষাকের অর্ডার বাড়ত বলেও খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here