তিন বছর আগে ২০১৬ সালের জুন মাসে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে ঘটা করে আশুগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ। তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে আশুগঞ্জে গিয়ে এই ট্রানজিট কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
ট্রানজিট দেওয়ার আগে ট্রানজিট সুবিধায় মাশুল কত এবং অবকাঠামো কেমন হবে এবং ভারত কী পরিমাণ পণ্য নেবে—এসব নিয়ে কয়েক বছর শুধু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ট্রানজিট দেওয়ার পর দেখা গেল, গত তিন বছরে মাত্র ১৩টি চালান ভারতের কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় গেছে। এই সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ মাশুল পেয়েছে মাত্র ২৮ লাখ টাকা। তিন বছরে ট্রানজিটের এই ফল।
গত পাঁচ মাসে ভারতের কোনো ব্যবসায়ী ওই পথে কোনো পণ্যের চালান নেননি। নৌপথটি ব্যবহারে সেই দেশের ব্যবসায়ীদের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তিন বছরে ট্রানজিট পণ্য হিসেবে ভারতে গেছে ইস্পাত, চাল, ভোজ্যতেল, পাথর ইত্যাদি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান নৌ প্রটোকলের আওতায় কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথে, আর আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলা পর্যন্ত সড়কপথে মাশুলের বিনিময়ে পণ্য নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
ট্রানজিট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ২০১২ সালের দিকে প্রথম আলোচনা শুরু হয়। কয়েক বছর দর-কষাকষির পর টনপ্রতি ট্রানজিট মাশুল নির্ধারিত হয় ১৯২ টাকা। এর বাইরে টনপ্রতি ৫০ টাকা নিরাপত্তা মাশুল এবং নৌবন্দরে ল্যান্ডিং শিপিং বাবদ টনপ্রতি সাড়ে ৩৪ টাকা মাশুল আছে। সব মিলিয়ে প্রতি টনে প্রায় ২৭৭ টাকা মাশুল পড়ে। এ ছাড়া মাঝনদীতে কার্গো জাহাজ অবস্থানের জন্য আলাদা মাশুল আছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নৌপথটি সময় ও খরচের দিক থেকে ত্রিপুরার জন্য লাভজনক। কয়েকটি চালান যাওয়ার পর ওই দেশের ব্যবসায়ীরা দেখেছেন, আশুগঞ্জে আন্তর্জাতিক মানের নৌবন্দর নেই। শুল্ক কার্যালয় ও বড় গুদাম নেই। এসব দেখে তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর মতে, এসব অবকাঠামো দ্রুত নির্মাণ করে এই ট্রানজিট পথ কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব।
কত পণ্য গেল
২০১৬ সালের জুন মাসে ট্রানজিট শুরু হওয়ার পর ওই বছর তিনটি চালানে ৪ হাজার ২৬২ টন পণ্য গেছে। এতে মাশুল পাওয়া গেছে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২০১৭ সালেও সব মিলিয়ে তিনটি চালান যায়। পণ্য গেছে ১ হাজার ৫৯৯ টন। মাশুল মিলেছে ৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি ছয়টি চালানে ৬ হাজার ৬৪২ টন পণ্য ত্রিপুরায় গেছে। ওই বছর এসব চালান থেকে মাশুল পাওয়া যায় ১০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। আর চলতি বছরে যায় মাত্র একটি চালান। গত এপ্রিল মাসে এমভি নিদেশ্বরী নামের একটি জাহাজে ২ হাজার ৮০ টন পাথর আগরতলায় নেওয়া হয়েছে। এতে মাশুল পাওয়া গেছে ১ লাখ টাকার বেশি। এরপর গত পাঁচ মাসে কোনো পণ্যের চালান আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে আগরতলায় যায়নি। তবে গত দুই মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগর থেকে আগরতলা পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেলপথের জন্য দুটি জাহাজে মালামাল গেছে। এটি অবশ্য ট্রানজিট পণ্য নয়। আশুগঞ্জ নৌবন্দরের পরিদর্শক শাহ আলম গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, এপ্রিল মাসের পর আশুগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে কোনো ট্রানজিট পণ্য যায়নি। ট্রানজিট দেওয়ার জন্য এই বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ নৌ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আগ্রহে স্বল্প মাশুলে এই পথে ট্রানজিট দিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। এ জন্য আশুগঞ্জ নৌবন্দরের ঘাট, গুদামসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এখন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই পথ ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে নৌবন্দরের কর্মকর্তারা জানান।
থমকে আছে অন্য উদ্যোগ
সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালের ৩ জুন আখাউড়া-আগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান গেছে। সড়কপথে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে আগরতলায় ওই চালান নেওয়া হয়। তাতে প্রতীকী মাশুল ছিল এক রুপি। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (বিবিআইএন) যান চলাচল চুক্তির অংশ হিসেবে এই পরীক্ষামূলক চালান গেছে। এটি আর নিয়মিত হয়নি। নিয়মিতভাবে শুরু হয়নি পর্যটন জাহাজ চলাচলও। এদিকে চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এক হাজার একর জমি ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের জন্য দেওয়া হয়েছে। মোংলায় দেওয়া হয়েছে ১০৫ একর জমি।