ইমদাদুল হক ২০১৬ সালে শুরু হয় আরও একটি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা। তাই নতুন সেই ভাবনায় যুক্ত হয় ‘রাস’ ও ‘বায়োফ্লক’ পদ্ধতিতে মাছ চাষ। এবং এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের শেষ সম্বলটুকু বিনিয়োগ করেছেন ইমদাদুল হক। করেছেন ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সম্পূর্ণ তিমি নতুন এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে তিনি এখন অন্যদের কাছে হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয়। ইমদাদুল হক এরই মধ্যে দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন একজন তরুণ ও সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে। ইমদাদুল হক জানান, তার বহুমুখী কর্মপ্রয়াসের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারের তীব্র আগ্রহ। ২০১৬ সালে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে ভিয়েতনামে রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়া কালচার সিস্টেম বা ‘রাস’ পদ্ধতিতে মাছ চাষের প্রজেক্ট দেখেন। এরপর ঢাকার সায়েন্স ল্যাবেও দেখেন একই প্রজেক্ট। মূলত সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেই ‘রাস’ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার পণ করেন। তিন মাসে আটবার ভাঙা-গড়া করেন। শেষ পর্যন্ত বাড়ির উঠানে রূপায়িত হয় তার আজকের এই ‘রাস’ পদ্ধতির মাছের খামার, যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দৃষ্টান্ত। বাইরে থেকে একটি সাধারণ পাকা বাড়ি মনে হলেও ভিতরে চলছে নীরব এক কর্মযজ্ঞ। এখানে নির্দিষ্ট আবর্তনের মধ্যেই উৎপাদন করা হচ্ছে পোনা থেকে শুরু করে বাজারজাত করার মতো উপযোগী মাছ। একেবারেই নতুন ও বিজ্ঞানসম্মত উদ্ভাবনী পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে একটি বাড়ির মধ্যেই কীভাবে মাছ তৈরির কারখানা করা সম্ভব ইমদাদুল হক জানালেন সেই সাফল্যগাথা। বলা হচ্ছে, মাছ চাষের আধুনিক ও ঘরোয়া পদ্ধতি হচ্ছে রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়া কালচার সিস্টেম বা ‘রাস’ পদ্ধতি। এর ব্যবহার ও উপকরণ-বাণিজ্যে বহুদূর এগিয়েছে চীন। চীনের জানসান এলাকায় ‘রাস’ পদ্ধতির উপকরণ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আছে। বহির্বিশ্বে এখন মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঝুঁকি এড়াতে ‘রাস’ একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি। এর প্রসার হচ্ছে দেশেও। রাজশাহীর কাটাখালী এলাকার বহুমুখী তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা ইমদাদুল হক বলেন, বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে বেশ কয়েকটি খামার গড়ে উঠেছে। এর অন্যতম একটি হচ্ছে তার খামার। ‘রাস’ পদ্ধতিতে ঘরের মধ্যে মাছ চাষ করায় ২৯ সেপ্টেম্বর শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়েছেন রাজশাহীর ইমদাদুল হক। রাজধানী ঢাকায় ‘সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা’ পুরস্কার দেওয়া হয় তাকে।
ঠিক কারখানার মতোই ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি করেছেন মাছের খামার। ‘রাস’ পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইমদাদুল হক জানান, প্রথমেই পাঁচ হাজার লিটার পানি ধারণক্ষমতার একটি ট্যাঙ্ক তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে আরও পাঁচ থেকে ছয়টা ট্যাঙ্ক করতে হবে। ট্যাঙ্কগুলোর মধ্যে একটি হবে মেকানিক্যাল ট্যাঙ্ক। মেকানিক্যাল ফিল্টারের মধ্যে মাছের বিষ্ঠা ঘুরবে। সেগুলো ঘুরে ঘুরে নিচে পড়ে যাবে। এরপর পানিটা ফিল্টার হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে আরেকটা বায়োলজিক্যাল ফিল্টারে পড়বে। বায়োালজিক্যাল ফিল্টারে যাওয়ার পর পানির মধ্যে অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট ও টক্সিনসহ যেসব বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হবে সেগুলো বের হয়ে যাবে। প্রক্রিয়াটি একটি ট্যাঙ্কেও সম্ভব। তবে পানিটা বেশি বিশুদ্ধ করতে তিনি পাঁচটি ট্যাঙ্ক ব্যবহার করেছেন। বায়ো ফিল্টারের মধ্যে ধাপে ধাপে পানি যেতে থাকবে এবং বিশুদ্ধ হতে থাকবে। পানি বিশুদ্ধ হওয়ার পর মোটরের মাধ্যমে রিজার্ভ ট্যাঙ্ক থেকে আবারও প্রতিটি মাছের ট্যাঙ্কে পৌঁছে যাবে। যে পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি মাছের ট্যাঙ্কের মধ্যে ঢুকবে ঠিক ততটুকু দূষিত পানি পাইপের মধ্য দিয়ে মাছের ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে যাবে। এভাবে মাছের বিষ্ঠা, খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ ও পানির মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াগুলো পরিশোধিত হয় বলে জানান ইমদাদুল হক। ‘রাস’ পদ্ধতির পাশাপাশি এখানে যুক্ত হয়েছে মাছ চাষের আরও একটি উদ্ভাবিত পদ্ধতি ‘বায়োফ্লক’। এই পদ্ধতি নিঃসন্দেহে রাসের চেয়ে এক ধাপ অগ্রগামী। বায়োফ্লকের সুবিধা হচ্ছে, এখানে খরচ আরও অনেক কম। এখানকার পানিটা প্রতিদিন পরিশোধন করারও প্রয়োজন হয় না। পানিটা এখানেই থেকে যাবে কিন্তু প্রোভাইটিক দিলে ওখানেই পানি ফিল্টার হয়ে যাবে। প্রোভাইটিকের যে ব্যাকটেরিয়াটা তৈরি হবে তা দিয়ে খাদ্যে রূপান্তরিত হয়ে যাবে মাছের উচ্ছিষ্ট। যে কেউ বাড়ির মধ্যে থাকা পরিত্যক্ত জায়গায় এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে পারবেন। একটা ১০০ লিটারের ড্রামে ১০০ পিস শিং মাছ দিলে এটা চার মাসে খাওয়ার উপযোগী হয়ে যাবে। এভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে এসে আগের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন ইমদাদুল হক।
আশাজাগানিয়া সফলতা আসায় এরপর কৈ ও শিং মাছ চাষ শুরু করেন। সেখানেও সোনা ফলে। কৈ ও শিং চাষের পর এবার দেশি মাগুর ও বিদেশি শৌখিন মাছ চাষ করেন। তার বাড়িতে গেলে মনে হবে পুরো উঠানটিই যেন জীবন্ত অ্যাকুরিয়াম। লাল, নীল ও সোনালি রঙের মাছগুলো ইমদাদুলের জীবনটাকেও যে রঙিন করে তুলেছে তা বোঝার অপেক্ষা থাকে না। রাস পদ্ধতিতে ইমদাদুল হক ছোট-বড় মিলিয়ে ৪২টি সিমেন্টের ট্যাঙ্ক ও ২২টি প্লাস্টিকের ড্রামে প্রায় তিন লাখ লিটার পানিতে উৎপাদন করছেন দেশি শিং, কৈ ও সৌখিন বিদেশি মাছ। একেকটি ট্যাঙ্কে ৬০০ থেকে ১৬ হাজার ৫০০ লিটার করে পানি রয়েছে। আর প্লাস্টিকের ড্রামে ১০০ থেকে ১ হাজার লিটার পানি আছে। তবে পুকুরের চেয়ে শতকরা ৩৫ ভাগ কম খরচে এখানে মাছ চাষ করা যাচ্ছে। ইমদাদুলের বাড়ির উঠানে কৈ, কার্প, মিল্কি, গোল্ডফিশ, কমেট, ব্ল্যাকমোরসহ প্রায় ২৫ রকমের রঙিন শৌখিন মাছ চাষ হচ্ছে। এসব মাছ উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে বায়োফ্লক পদ্ধতি। এখানে শুরুতে অবকাঠামোতে ব্যয় করেছেন ৮ লাখ টাকা। এটি ছিল স্থায়ী বিনিয়োগ। এরপর মাছ চাষে যা বিনিয়োগ করছেন, সে তুলনায় লাভ পাচ্ছেন প্রায় চারগুণ। বাড়ির উঠানে করা এই মাছের আধুনিক খামার তার ভাগ্য ফিরিয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার রাস পদ্ধতির এই মৎস্য খামার সম্প্রসারণে আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান সফল এই উদ্যোক্তা।