দীর্ঘদিন বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখলেও সম্প্রতি এক ধাপ পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।তাই বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার চীনের পেছনে অবস্থান এখন ভিয়েতনামের। অর্থাৎ পোশাক রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। অন্যদিকে ব্যবসায় অনবরত ক্ষতির মুখে পড়ে গত সাত মাসে ছোট বড় মিলিয়ে এখন পযন্ত দেশের ৭৮টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ হারিয়েছে অসংখ্য শ্রমিক। সব মিলিয়ে পোশাক খাতে এখন সুবাতাস বইছে না। বরং তীব্র প্রতিযোগিতায় পড়ে এবং বাজার ধরে রাখার লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছেন পোশাক ব্যবসায়ীরা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরই হয়তো ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান হারাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে যাওয়ায় এই শঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরের প্রথম ৯ মাসে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছে ভিয়েতনাম। ইপিবি’র তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ৬১০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের পোশাক। অর্থাৎ ৯ মাসে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম ৩২০ কোটি ডলারের পোশাক বেশি রপ্তানি করেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে ভিয়েতনাম অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম যে বাংলাদেশকে ধরে ফেলতে যাচ্ছে তা অবশ্য কয়েক মাস আগেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০১৯-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র নেতারা জানান, বাংলাদেশ থেকে কিছু ক্রয়াদেশ স্থানান্তর হয়ে মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে চলে যাচ্ছে। ২য় প্রতিযোগী দেশগুলোর স্থানীয় মুদ্রা ডলারের বিপরীতে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এতে সেই দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক দরে অর্ডার নিতে পারছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী মন্দাভাব বিরাজ করায় পোশাকের দরও এখন কমতির দিকে। তারা আরও জানান, পোশাক বাজারে বৈশ্বিক চাহিদায় এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিদেশের ক্রেতারা এখন বেছে বেছে পোশাক কিনছেন বা কম কিনছেন। তারা ভ্যালু এডেড পোশাকের দিকে ঝুঁকছেন। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে যেখানে মেনমেইড ফাইবারের চাহিদা বাড়ছে সেখানে বাংলাদেশ এখনো কটন ফাইবারের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া ভালো লজিস্টিক সাপোর্ট, বন্দর সুবিধাসহ অন্যান্য কারণে চীন থেকে রপ্তানি আদেশ ভিয়েতনামে বেশি যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত কারণে ভিয়েতনামের শ্রমিকদের সক্ষমতাও বাংলাদেশের শ্রমিকের চেয়ে বেশি। আবার ভিয়েতনাম ছাড়াও মিয়ানমার ও ইথিওপিয়াতেও নতুন করে অর্ডার যাচ্ছে।
বিজিএমইএর প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চিটাগাং এশিয়ান এপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধি পাওয়ায় মালিকরা ক্রেতার কাছ থেকে এই বাড়তি মূল্য আদায় করছেন। এতে ক্রেতারা আরও কম দামে অন্য বাজারের দিকে ঝুঁকছেন। ভিয়েতনামে কম দামে পোশাক পাওয়ায় তাদের রপ্তানি আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কারেন্সি ডিভ্যালিউশন করায় পোশাক রপ্তানি কিছুটা কমেছে। নতুন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে দেশের পোশাক খাতের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগের থেকে কম অর্ডার দিচ্ছে। আবার দেশে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব এই খাতের ওপর পড়েছে। রপ্তানি আয় হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বিগত কয়েক মাসে নতুন করে আরও বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই খাতের ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজিএমইএর তথ্যে, বিগত কয়েক মাসে দেশের ৭৮টি ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়েছে। মূলত মালিকরা যে অর্ডার পাচ্ছেন তাতে তারা লোকসানে আছেন। আর এভাবে বেশি দিন ক্ষতি করে তাদের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। এই অবস্থায় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি করে ৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার অর্জন করার যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল তা অর্জন করা খুব বেশি চ্যালেঞ্জের বলে পোশাক কারখানার মালিকরা আশঙ্কা করছেন। বিজিএমইএ নেতারা বলেন, আমরা বাজেটে সরকারের কাছে ৫ শতাংশ প্রণোদনা চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার দিয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। তবে এই সংকট কাটাতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে টাকার মান পুনর্নির্ধারণ করা গেলে পোশাক খাতের উন্নতি হবে।