মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মানুষ যে ধ্বনি ব্যবহার করে তা হলো ভাষা। আর নিজেদের মায়েরা যে ভাষায় কথা বলে তা মাতৃভাষা। মাতৃভাষা আল্লাহ তায়ালার অপার নেয়ামত। মাতৃভাষা চর্চা বা বিশুদ্ধভাবে কথা বলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুপম সুন্নত। যেসব গুণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে অর্থবহ এবং প্রশংসনীয় করে তোলে তার মধ্যে বিশুদ্ধ ভাষা ও সুস্পষ্ট উচ্চারণ অন্যতম। পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারের বেশি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। সবার ভাষা এক নয়। জাতি ও মানচিত্রভেদে একেকজন একেক ভাষায় কথা বলে। বিচিত্র এসব ভাষায় বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ কথা বলে। এ ভাষাগুলোই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের মাতৃভাষা। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম : আয়াত ২২)

কোরআনে মাতৃভাষার গুরুত্ব
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৎপথ দেখানোর জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল (আ.) পাঠিয়েছেন। তাদের ওপর যেসব আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছিল সেগুলোর ভাষা ছিল ওই নবী-রাসুলদের স্বজাতির ভাষা। নবী-রাসুলদের কাছে পাঠানো আসমানি কিতাবসমূহ মাতৃভাষায় অবতীর্ণ না হলে সেগুলো তাদের জাতি ও সম্প্রদায় বুঝতে পারত না। ফলে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত। মাতৃভাষার সঙ্গে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি জড়িত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য…।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪)
হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির মাতৃভাষা ছিল সুরিয়ানি, তাই সুরিয়ানি ভাষায় তার প্রতি ইনজিল অবতীর্ণ হয়। হজরত মুসা (আ.)-এর জাতির ভাষা ছিল ইবরানি, তাই ইবরানি ভাষায় তাওরাত অবতীর্ণ হয়। হজরত দাউদ (আ.)-এর জাতির ভাষা ছিল ইউনানি, তাই ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় যাবুর অবতীর্ণ হয়। আর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার আগমনাঞ্চলের ভাষা ছিল আরবি, তার প্রথম ও প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিলেন আরবরা, তাই সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোরআনুল কারিম আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়। আসমানি কিতাবসমূহ যদি নবী-রাসুলদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় না হয়ে ভিন্ন ভাষায় নাজিল হতো, তাহলে নিজেদের উম্মতদেরকে দীনের আলোর দিকে আহ্বান করা নবী-রাসুলদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যেত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরবের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃভাষায় তার দক্ষতা ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন ভাষা ও সাহিত্যে সর্বাধিক নৈপুণ্যের অধিকারী, আরবের সবচেয়ে স্পষ্ট ও বিশুদ্ধভাষী। তার বাচনভঙ্গি, মাতৃভাষায় বিশুদ্ধতা এবং উচ্চারণের সুস্পষ্টতা ছিল রাসুলচরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী।’ তার মাতৃভাষা আরবি হওয়ায় মুসলমানদের অনুসৃত ধর্মগ্রন্থ কুরআনুল কারিম আল্লাহ তায়ালা আরবি ভাষায় নাজিল করেছেন। যেন সুপথভ্রান্ত লোকেরা সহজেই তাওহিদ বা একত্ববাদ স্বীকার করে ইসলামি জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে এবং কিতাবপ্রাপ্ত নবী-রাসুলরা সহজেই দীনের দাওয়াত দিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এরপর আমি এ কুরআনকে আপনার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি। যাতে মুত্তাকিদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে পারেন, আর এর সাহায্যে কলহে লিপ্ত জাতিকে জাহান্নামের ভয় দেখাতে পারেন।’ (সুরা মারিয়াম : ৯৭)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘এটা রুহুল আমিন জিবরাইলের মাধ্যমে আপনার অন্তঃকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। যাতে ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারেন।’ (সুরা শুয়ারা : ১১৩-১১৫)

এসব আসমানি কিতাব মাতৃভাষায় নাজিল না হলে এগুলো নাজিলের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতো। কারণ আসমানি কিতাব নাজিলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পুণ্য অর্জনের জন্য এর মর্ম অনুধাবন করা এবং ব্যক্তি ও সমাজজীবনে এর আলোকে জীবনব্যবস্থা কায়েম করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যদি আমি কুরআন অনারবদের ভাষায় নাজিল করতাম তবে অবশ্যই বলতো, এর আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়নি কেন? এটা কেমন কথা, অনারবি কিতাব আর আরবিভাষী রাসুল! আপনি বলুন, এই কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াতস্বরূপ এবং ব্যাধির প্রতিকারস্বরূপ। কিন্তু যারা ঈমান আনে না, তাদের কাছে রয়েছে বধিরতা। আর কুরআন তাদের জন্য অন্ধত্বস্বরূপ।’ (সুরা হা মিম সাজদা : ৪৪)। আল্লাহ তায়ালা অন্য একটি আয়াতে বলেন, ‘আমি তো কুরআন আরবিতে নাজিল করেছি এজন্য যে, তোমরা তা বুঝবে।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ২)

হাদিসে মাতৃভাষার গুরুত্ব
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন।’ হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী; কুরাইশ গোত্রে আমার জন্ম।’ হজরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে তার স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ) তিনি আরো বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু কথা জাদুময়।’ (বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে যেমন ভাষার প্রতি যত্নবান ছিলেন তেমনি অন্যদেরও যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি কাউকে শব্দের ভুল প্রয়োগ বা ভাষার বিকৃতি করতে দেখলে তা শুধরে দিতেন। একবার এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বললেন, ‘আ-আলিজু’। শব্দটির অর্থ ‘আমি কি প্রবেশ করব?’ আরবি ভাষায় এ অর্থে ব্যবহৃত হলেও তা অনুমতি প্রার্থনার জন্য যথেষ্ট নয়। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর গোলামকে বললেন, বাইরে গিয়ে তাকে একথা বলতে বল, ‘আসসালামু আলাইকুম! আ-আদখুলু?’ কারণ সে সুন্দরভাবে অনুমতি প্রার্থনা করেনি। (আল-আদাবুল মুফরাদ)। ইমাম মুসলিম (রহ.) তার সহি মুসলিমে ‘আল-আলফাজু মিনাল আদাব’ শিরোনামে অধ্যায় এনেছেন। সেখানে উপযুক্ত শব্দচয়ন সম্পর্কে হাদিস আনা হয়েছে। এ অধ্যায়ের হাদিসগুলোতে রাসুলুল্লাহ (সা.) ভুল শব্দ প্রয়োগের সংশোধনী এনেছেন এভাবেÑ ‘আঙ্গুর’কে ‘কারম’ বলো না, ‘ইনাব’ কিংবা ‘হাবালাহ’ বলো। কাউকে ‘দাস’ না বলে ‘চাকর’ বলো, কারণ সবাই আল্লাহর দাস ও দাসী; মনিবকে ‘প্রভু’ বলো না, ‘সরদার’ বলো।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের ভাষার রয়েছে এক রক্তমাখা ইতিহাস। তাই শুদ্ধ বাংলা শেখা ও শেখানো এবং বলায়-লেখায় শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ, শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারও রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নত।
মুনিরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here