এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গত বছরের চেয়ে এবার পাশের হার কমেছে। আর প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে জিপিএ-৫ সংখ্যাও। এতে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কমতি ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মাঝে। করোনা মহামারির পর এ বছর সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বর এবং পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। সিলেবাস কিছুটা কমানো হলেও তারা সময় কম পেয়েছে। কিছু বিষয়ের প্রশ্ন তুলনামূলক কঠিন হয়েছে। অন্যদিকে এসএসসিতে তারা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পাশ করে এসেছে। তাই অন্যবারের তুলনায় এবার শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। বরাবরের মতো এবারও ইংরেজিতে অকৃতকার্যের হার বেশি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মোট ফলে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬২ দিনের মাথায় রোববার এই ফল প্রকাশ করা হয়।
১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার এইচএসসি, আলিম, এইচএসসি (বিএম-ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা) ও ডিপ্লোমা ইন কমার্স পরীক্ষা নেওয়া হয়। এবার সবমিলে পাশের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত বছর এটা ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯২ হাজার ৫৯৫ জন শিক্ষার্থী। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। অর্থাৎ পাশের হার কমেছে ৭.৩১ শতাংশ আর জিপিএ-৫ কমেছে ৮৩ হাজার ৬৮৭টি।
ছাত্রদের তুলনায় এবারও পাশ এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে ছাত্রীরা এগিয়ে আছে। এ বছর সব শিক্ষা বোর্ডে মেয়েরা ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি পাশ করেছে। ৬ হাজার ১৩৫ জন ছাত্রী বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে।
এ বছর মোট পরীক্ষা দেয় ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৪২ জন। তাদের মধ্যে ছাত্র ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৭ জন এবং ছাত্রী ৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৫৫ জন। পাশ করেছে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন। পাশ করাদের মধ্যে ছাত্র ৫ লাখ ২৮ হাজার ৯১৯ জন এবং ছাত্রী ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৩ জন। অন্যদিকে আলাদাভাবে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষা দেয় ১১ লাখ ১২ হাজার ৩৭২ জন। তাদের মধ্যে ৮ লাখ ৪৪ হাজার ২৬৯ জন পাশ করেছে। পাশের হার ৭৫.৯০ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৮ হাজার ৫২১ জন।
দুপুর আড়াইটায় রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে (আমাই) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তবে সকাল ১০টার দিকে ফল প্রকাশের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর এক ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীদের জন্য ওয়েবসাইট এবং এসএমএসসহ ডিজিটাল মাধ্যমে ফল জানার ব্যবস্থা উন্মুক্ত করা হয়। পাশাপাশি একই সময়ে নিজ নিজ কলেজ ও মাদ্রাসা থেকেও শিক্ষার্থীরা ফল জানতে পেরেছে। আনুষ্ঠানিক ফল প্রকাশ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিবসহ বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
চলতি বছর ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় ১৭ আগস্ট; আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পিছিয়ে যাওয়া তিনটি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা (চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড) শুরু হয় ২৭ আগস্ট। এবার পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচি অনুযায়ী একটি ছাড়া সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা হয়েছে। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) পরীক্ষা শেষ সময়ে এসে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ৭৫ নম্বরে নেওয়া হয়।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে ইংরেজিতে গড়ে ১৭ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পাশের হার চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, আর সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বোর্ডে ৭৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
অন্যদিকে মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে মোট পাশের হার ৯০ শতাংশ। ইংরেজি বিষয়ে ফল ভালো হওয়ার কারণেই মূলত এ দুটি বোর্ডের সার্বিক ফল ভালো হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে ইংরেজিতে পাশের হার যথাক্রমে ৯৬ এবং ৯৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এছাড়া ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে যশোর বোর্ডে। পাশের হার ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাশের হার ৭৭.৩৬ শতাংশ, যা সারা দেশে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এছাড়া পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ পাশের হার মাদ্রাসা বোর্ড ও সর্বনিম্ন পাশের হার দিনাজপুর বোর্ড। এটা যথাক্রমে ৯৭.১১ এবং ৮৮.৯৯ শতাংশ। রসায়ন বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ পাশের হার মাদ্রাসা ও সর্বনিম্ন দিনাজপুর বোর্ড। এটা যথাক্রমে ৯৯ এবং ৮৫.৩৩ শতাংশ। হিসাববিজ্ঞানে সর্বোচ্চ পাশের হার বরিশাল বোর্ড ও সর্বনিম্ন দিনাজপুর বোর্ডে। এটা যথাক্রমে ৯২.৩৮ এবং ৬৫.৭৮ শতাংশ। আইসিটিতে সর্বোচ্চ পাশের হার কারিগরি বোর্ড ও সর্বনিম্ন চট্টগ্রাম বোর্ডে। এটা যথাক্রমে ৯৯.৬৯ ও ৮১.৬৩ শতাংশ। সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সারা দেশে ইংরেজিতে এবার সর্বোচ্চ পাশের হার চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮৮.৯১ শতাংশ। বোর্ডভিত্তিক ফলে পাশের হারে সবার ওপরে বরিশাল বোর্ড। এ বোর্ডে পাশের হার ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ঢাকা বোর্ডের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি ভালো করেছে। বোর্ডটিতে পদার্থবিজ্ঞানে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৬.১৬ এবং রসায়নে ৯৬.৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন বছর পর ২০২৩ সালে এসে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা দেয় শিক্ষার্থীরা। কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পরীক্ষা হয় ৭৫ নম্বরে। তবে এবারও বাগড়া দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এমনিতে প্রতিবছর সব বোর্ডের পরীক্ষা একসঙ্গে হলেও এবার প্রবল বৃষ্টি আর ঢলের কারণে তিন বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হয় দেরিতে। তাছাড়া ইংরেজিসহ কয়েকটি বিষয়ে খারাপ করার কারণে ফল খারাপ হয়েছে।
এবার পাশের হার সবচেয়ে কম যশোর শিক্ষা বোর্ডে। এ বিষয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আহসান হাবীব বলেন, ইংরেজি অনেকের কাছে কঠিন বিষয়। এবার যশোর বোর্ডে পরীক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ এই বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। তাই পাশের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে এই বোর্ড।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে হয়েছে। এতে পাশ ও জিপিএ-৫ এর হার কমলেও এটা একটি স্থিতিশীল ফল। এর ধারাবাহিকতাও রয়েছে।
পাশের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমার কারণ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘গতবার পরীক্ষা সহজ ছিল। কম বিষয়, কম সময় ও কম নম্বরের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। এবার পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা হয়েছে। এজন্য পরীক্ষাটাও তুলনামূলক কঠিন হয়েছে। এ কারণে পাশের হার ও জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে।’
এইচএসসির ফল চ্যালেঞ্জে আবেদন শুরু আজ : পরীক্ষায় কেউ ফেল করলে বা কাঙ্ক্ষিত ফল না পেলে, তা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ রয়েছে। ফল পুনঃনিরীক্ষণের এ আবেদন আজ থেকে শুরু হবে। চলবে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শুধু টেলিটকের প্রিপেইড নম্বর থেকে এসএমএসের মাধ্যমে এ ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করা যাবে। প্রতি পত্রের ফল পুনঃনিরীক্ষার ফি ১৫০ টাকা।