গাজায় ইসরাইলি বিমানবাহিনীর তীব্র হামলার মধ্যেই ইসরাইলের ভেতরে তুমুল লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ইসরাইলের হামলা থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

অব্যাহত বিমান হামলায় গাজা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলি বিমানবাহিনীর ৫০টি বিমান একযোগে হামলা চালিয়ে হামাসের লঞ্চিং প্যাডসহ গাজার ৮০০ লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করেছে। গাজায় টনে টনে বোমা ফেলছে ইসরাইলি বাহিনী।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রোববার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে আরও সামরিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি জানান, সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে জাহাজ ইসরাইলের পথে রয়েছে। বাইডেন সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত ও নিখোঁজের ঘটনায় নেতানিয়াহুকে গভীর সহানুভূতি জানান।

এদিকে গাজায় হামাসের হাতে জিম্মিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিক রয়েছেন বলে ইসরাইলের স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফয়ার্স মন্ত্রী রন ডেরমার জানান। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, তারা এই খবরের সত্যাসত্য যাচাই করে দেখছেন।

ইসরাইলি বিমান হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের কারণে বন্ধ হয়ে আছে গাজার প্রধান সড়ক। শনিবার রাত থেকে সেখানে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের জরুরি সেবা। এ হামলায় ৩৭০ নিহত এবং প্রায় ২,০২২ জন আহত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

এদিকে হামাসের আকস্মিক রকেট নিক্ষেপের ঘটনায় এরই মধ্যে ৬০০ জনের বেশি ইসরাইলি নিহত হয়েছে। আর জেরুজালেম পোস্ট জানিয়েছে, কমপক্ষে ৭৫০ ইসরাইলি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। ইসরাইলের সেনাবাহিনী ৪৪ সদস্য নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে। আর পুলিশও ৩০ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার তথ্য স্বীকার করেছে।

তবে হামাসের চারশর বেশি যোদ্ধাকে হত্যার দাবি করেছে ইসরাইল। এ পরিস্থিতিতে আগামী ১২ ঘণ্টার মধ্যে গাজা দখলের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে ইসরাইলের সেনাবাহিনী। খবর এএফপি, বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা, স্কাই নিউজের।

হামাসের তৎপরতা রোধে এবার ইসরাইলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেখানকার সিকিউরিটি ক্যাবিনেট। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘স্টেট অব ওয়ার’ ঘোষণার মাধ্যমে সিকিউরিটি ক্যাবিনেট সরকারকে প্রয়োজনীয় সামরিক তৎপরতা পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে।

নেতানিয়াহু বলেছেন, গাজা থেকে ভয়াবহ হামলার মাধ্যমে ইসরাইলের ওপর এ যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ইসরাইলের আইনপ্রণেতাই এবার দেশের এ পরিস্থিতির জন্য ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো নিপীড়নকে দায়ী করেছেন।

ইসরাইলের পার্লামেন্টের সদস্য এবং বামপন্থি হাদাস জোটের ওফর ক্যাসিফ আলজাজিরাকে বলেছেন, তিনি আগেই এ ব্যাপারে সাবধান করেছিলেন। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের প্রতি নেতানিয়াহুর নীতির পরিবর্তন না করলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে তিনি হুঁশিয়ার করেছিলেন।

ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) রোববার বলেছে, সংঘাতের দ্বিতীয় দিনে তারা গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ওপর মনোযোগ দিচ্ছে। আইডিএফের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচট এক ব্রিফিংয়ে বলেন, আমাদের এখনকার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে গাজা উপত্যকাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা।

এজন্য আমরা আগামী ১২ ঘণ্টাকে লক্ষ্য হিসেবে ধরেছি। এই সময়ের মধ্যেই গাজাকে নিয়ন্ত্রণে এনে আমাদের ভূখণ্ডে আসা সব সন্ত্রাসীকে হত্যা করব। তবে আইডিএফ জানিয়েছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আটটি স্থানে হামাস বিদ্রোহীদের সঙ্গে এখনো তাদের লড়াই চলছে। ইতোমধ্যে তারা হামাসের ৫০০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে।

সেনাবাহিনী জানিয়েছে, শনিবার থেকে শুরু হওয়া এ পর্যন্ত সংঘাতে ৪৪ জন সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। সেনাবাহিনী নিহত সেনাদের নামসহ বিস্তারিত তথ্যও প্রকাশ করেছে এবং নিহতদের পরিবারকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে।

এদিকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজা উপত্যকার কাছাকাছি থাকা সব ইসরাইলিকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। ইসরাইলে ঢুকে পড়া ফিলিস্তিনের বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতেই তারা এ পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব ইসরাইলিকে গাজার আশপাশ থেকে সরিয়ে নেওয়া।

তিনি বলেন, ইসরাইলে বিদ্রোহীদের হাতে অপহৃত হওয়া বন্দিদের মুক্তির লক্ষ্যে লড়াই চলছে। শনিবার ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে প্রতিশোধ নিতে হামাসের এক হাজারেরও বেশি সদস্য ঢুকে পড়েন। ইসরাইলে ঢুকে হামাসের যোদ্ধারা বেশ কয়েকজন ইসরাইলি সেনা ও বেসামরিক মানুষকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নিয়ে আসেন। আবার অনেকে ইসরাইলের ভেতরে অবস্থান নেন এবং বিভিন্ন সামরিক অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নেন।
ইসরাইলি শহরগুলোতে অবস্থান নেওয়া হামাসের যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসরাইলি বাহিনী এখন সম্মুখ লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে। এ লড়াইয়ে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। চারশরও বেশি হামাস যোদ্ধাকে হত্যার পাশাপাশি বেশ কয়েকজনকে আটক করার দাবিও করেছে ইসরাইল। এছাড়া ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হামলা চালিয়ে হামাসের কিছু সদস্যকেও হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি।

রোববার তিনি টাইমস অব ইসরাইলকে বলেছেন, ‘এ মুহূর্তে সেনারা কাফার আজায় লড়াই করছে, শহরের বড় অংশজুড়ে তল্লাশি অভিযান চলছে। আইডিএফের সেনারা শহরের সব জায়গায় আছে। এমন কোনো শহর নেই যেখানে আইডিএফের সেনারা নেই।’

ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় দক্ষিণে রাফাহ থেকে উত্তরে বেইট হানুন (ইসরাইলিদের কাছে এরেজ নামে পরিচিত) এলাকা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি শহরে বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে বহু মানুষ। অন্যদিকে গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি হামলায় নিহতদের মধ্যে ২০ শিশুও রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় নিহতদের মধ্যে ২০ শিশু এবং কমপক্ষে আরও ১২০ জন নাবালক আহত হয়েছে।

মিসরে ইসরাইলি পর্যটক বাসে হামলা : মিসরে ইসরাইলের পর্যটকদের একটি বাসে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে মিসরের গাইডসহ দুই ইসরাইলি নিহত হয়েছেন। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, মিসরের স্থানীয় এক ব্যক্তি ইসরাইলের পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি করলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। তিনি এখন নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। গত কয়েক দশকের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম। রোববার স্থানীয় হিব্রু ও আরবি ভাষার একাধিক গণমাধ্যম বলছে, মিসরে ইসরাইলি পর্যটক বোঝাই একটি বাসে বন্দুকধারীর গুলিতে অন্তত দুই ইসরাইলি নিহত হয়েছেন।

আরব লিগের জরুরি মিটিং আহ্বান : আরব লিগের জরুরি মিটিং আহ্বান করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। আরব লিগে ফিলিস্তিনের স্থায়ী প্রতিনিধি আকলুক বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি মিটিং আহ্বান করে একটি অনুরোধ জমা দিয়েছেন আরব লিগে। ওয়াফা বার্তা সংস্থা বলেছে, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলি চলমান আগ্রাসনের আলোকে এই মিটিং আহ্বান করা হয়েছে।

বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া : ইসরাইলে হামাসের রকেট নিক্ষেপের ঘটনায় প্রায় ৬০০ মানুষ নিহতের ঘটনায় সারা বিশ্বের নেতারা নিন্দা জানিয়েছেন। কোনো কোনো দেশ এ ঘটনায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে বলে মন্তব্য করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পাশেই রয়েছে। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, ইসরাইলকে অতিরিক্ত সামরিক সহায়তা দেওয়া হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ফিলিস্তিনের হামাস এবং ইসলামিক জিহাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। ইরানে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এ আলাপের তথ্য জানালেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। আর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির এক সিনিয়র উপদেষ্টা হামাসের রকেট নিক্ষেপের ঘটনাকে সমর্থন করেছেন।

তিনি এ অভিযান নিয়ে গর্বিত বলে জানিয়েছেন। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুই পক্ষকেই সংযত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্কও অবিলম্বে সবাইকে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। চীনের পক্ষ থেকেও এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রোববার বলেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইলের বর্তমান উত্তেজনা ও সহিংসতা বৃদ্ধির ঘটনায় চীন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শান্ত থাকার, সংযম চর্চার আহ্বান জানাই।