চট্টগ্রামে পাহাড় রক্ষায় বিভিন্ন সময় নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। বছরের পর বছর পাহাড় কাটা যেমন অব্যাহত থাকে, তেমনি কাটা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়তে থাকে। প্রতি বছরই বর্ষায় পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরাতে তোড়জোড় শুরু করে জেলা প্রশাসন। বর্ষা শেষ হলেই বাসিন্দারা ফিরে যায় পুরোনো ঠিকানায়। সরকারি হিসাবে নগরীর ২৬ পাহাড়ে এখনো বসবাস করছে সাড়ে ৬ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ। অব্যাহতভাবে কাটার কারণে চার দশকে অন্তত ১২০টি পাহাড় প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক সদেচ্ছার অভাবে পাহাড় কাটায় জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা যায় না। আবার পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি পাহাড় রক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরাতে নানা সুপারিশ করলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় না। প্রশাসনের এমন দৈন্যের কারণে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা যেমন বন্ধ করা যাচ্ছে না; তেমনি বর্ষায় কাটা পাহাড়ে ঝুঁকিও এড়ানো যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অলিউর রহমান বলেন, ‘চার দশক আগেও বন্দরনগরীতে ২০০ পাহাড় ছিল। যার মধ্যে ৬০ শতাংশ কেটে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন সময় জরিমানা করেই দায় সেরেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পাহাড় কাটার সঙ্গে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মহল জড়িত। তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কখনো বা জরিমানা দিয়েই পাহাড় কেটে চলেছে। প্রশাসন এ ক্ষেত্রে কখনো সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। কখনো বা দায়সারা ব্যবস্থা নেয়। এ কারণে চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় কাটা অব্যাহত রয়েছে।’

সূত্র জানায়, নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন সাইফুদ্দিন খালেদ সড়কে এবিসি প্রপার্টিজের সঙ্গে লাগানো একটি পাহাড় কাটার সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে প্রভাবশালীরা। চারদিকে সুউচ্চ টিনের ঘেরা দিয়ে পাহাড় কেটে বহুতল ভবন বানানোর প্রস্তুতি চলছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও এই পাহাড়ে ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে বলে জানা গেছে। আর এভাবেই পাহাড় রক্ষার পরিবর্তে অনেক সময় দায়িত্বশীল সংস্থাও পাহাড় কাটার পথ সুগম করে দিচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুয়ায়ী, বর্তমানে নগরীর ২৬ পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী রয়েছে ৬ হাজার ৫৫৮ পরিবার। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। প্রতি পরিবারে গড়ে ৫ জন সদস্য থাকলেও এসব পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে লক্ষাধিক মানুষ। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত ২৭টি সভা করেছে কমিটি। প্রতিটি সভায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বসবাসকারীদের বাসায় অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে ১৬ বছরেও কমিটির ৩৬টি সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান  বলেন, ‘পাহাড়ে কীভাবে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ গেল সেটি সভা করে সিদ্ধান্ত করার বিষয় নয়। গিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়। মূলত পাহাড় রক্ষার সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা পাহাড় দখল করে রাখায়, তাদের সঙ্গে প্রশাসন হয়তো পেরে উঠছে না।’

সূত্র জানায়, প্রতি বছর মৌসুমের টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে পাহাড় ধস ও প্রাণহানির ঘটনা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর এবং আশপাশের এলাকায় গত ১৬ বছরে পাহাড় ধসে ২৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকে। এত হতাহতের পরও চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন ও বসবাস বন্ধ হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওই দিন ভোরে অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড় ধসে নারী-শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, নগরীর ২৬ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে ৬ হাজার ৫৫৮ পরিবার। এর মধ্যে সরকারি ১৬ পাহাড়ে ৬ হাজার ১৭৫ পরিবার এবং বেসরকারি ১০ পাহাড়ে বসবাস করছে ৩৮৩ পরিবার।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদ কামাল বলেন, ‘সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ে বসবাসরত ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরাতে স্ব স্ব সংস্থা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কেউ যদি জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চায় আমাদের পক্ষ থেকে তা করা হবে।’