ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও (চসিক) ‘বাসিলাস থুরিংয়েনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)’ ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। মশার লার্ভা ধ্বংস করতে পরীক্ষামূলকভাবে শীঘ্রই আবদ্ধ পানিতে এ অর্গানিক ট্যাবলেট ব্যবহার করা হবে। চসিকের নিজস্ব কর্মী দিয়ে ব্যবহারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝেও বিটিআই ট্যাবলেট বিতরণের পরিকল্পনা আছে চসিকের। গত তিন দশক ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে এ ব্যাকটেরিয়া টেকনোলজি’র ব্যবহার হয়ে আসছে। কলকাতায় ১৯৯৬ সাল থেকে ব্যবহার করছে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন গত সপ্তাহে বিটিআই ব্যবহারের ঘোষণা দেয়।
চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. আবুল হাশেম দৈনিক আজাদীকে জানান, গতকাল বুধবার বিটিআই সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে মিটিং হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের জন্য ৫ লাখ টাকার বিটিআই সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠানটি। পরীক্ষামূলক ব্যবহারে সাফল্য এলে পরবর্তীতে সারা বছর তা ব্যবহার করবে চসিক।
তিনি বলেন, আমরা নিজেরা প্রয়োগ করব। সাথে সাথে মানুষের মাঝেও বিতরণ করব বিটিআই ট্যাবলেট। মানুষ তাদের পানির রিজার্ভারে বা অন্য যেখানে পানি জমে থাকে সেখানে ব্যবহার করতে পারবে।
আমেরিকার রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) এবং এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) তাদের ওয়েবসাইটে বিটিআই নিয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। ওয়েবসাইট দুটির তথ্য এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বিটিআই এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা প্রাকৃতিভাবে মাটিতে জন্মায়। এটা মশা–মাছিসহ অন্যান্য পতঙ্গের লার্ভা ধ্বংস করে। লার্ভা ধ্বংসের মাধ্যমে মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইয়োলো ফিভার ও জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে আসে বলে সিডিসি’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ মশা মারতে পারে না। বিটিআই পরিবেশবান্ধব। এটার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। মানুষের শরীরেরও কোনো ক্ষতি করে না। পানিতে বিটিআই দিলে অন্য জলজ প্রাণীর কোনো ক্ষতি হয় না। ২০০ লিটার পানিতে একটি বিটিআই ট্যাবলেট দেয়া যাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিটিআই এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া টেকনোলজি, অণুজীব। এটা পরিবেশবান্ধব এবং খুব ভালো একটা টেকনোলজি। নালায় দিলে ব্যাকটেরিয়া মশার লার্ভা ধ্বংস করে ফেলবে। এটা কোনো কেমিক্যাল না, পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি করে না। সিঙ্গাপুর, ভারতসহ আরো অনেক দেশে এটা ব্যবহার করা হয়। এটা বেশ কার্যকরও।
তিনি বলেন, বিটিআই বায়ো টেকনোলজি। ২০২১ সালে আমরা যে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিলাম সেখানে এটার সুপারিশ ছিল। আমরা কেমিক্যাল এর ব্যবহার কমিয়ে জৈব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে সুপারিশ করেছিলাম। সেখানে অণুজীব এর মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। প্রেজেন্টেশনের সময় বিটিআই নিয়ে স্লাইডের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এখন ঢাকায় ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়ার পর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও ব্যবহারে আগ্রহী হলে খুব ভালো হয়।
চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহী আজাদীকে বলেন, বিটিআই অর্গানিক ট্যাবলেট। লার্ভিসাইড হিসেবে কাজ করবে। যে কোনো ধরনের পানির ধারকে এটা ব্যবহার করা যাবে। জনস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর নয়। বিটিআই সংগ্রহে দাপ্তরিক কাজ চলমান আছে। চসিক সূত্রে জানা গেছে, মশার লার্ভা ধ্বংস করতে বর্তমানে ‘টেমিফস–৫০ ইসি’ নামে একটি কেমিক্যাল ব্যবহার করে সংস্থাটি। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ মশা মারতে এডাল্টিসাইড ফগিং করা হয়। গত ২২ জুন থেকে ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে এসব কীটনাশকের প্রয়োগ করা হচ্ছে। ৯ জুলাই থেকে মশার উৎসস্থল খুঁজতে ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মশা। চলমান অভিযানের মধ্যেই চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ ইতোমধ্যে প্রজননস্থল হিসেবে ৪৩৩টি মশার হটস্পট চিহ্নিত করে। এছাড়া ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এমন এলাকাগুলোকে ভিত্তি করে আরো ৫৭টি হটস্পট চিহ্নিত করে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তরের জরিপে দেখা যায়, নগরের ৩০ শতাংশ বাসা–বাড়িতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। এছাড়া ২১টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ শতাংশ।
এদিকে বাড়ছে ডেঙ্গু সনাক্তের হারও। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১১১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৫২ জনে। অর্থাৎ নানা চেষ্টার পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না এডিস মশা। এ অবস্থায় বিটিআই ব্যবহারের উদ্যোগ নেয় চসিক।