শাহ আবদুল করিমের গানে বারবার ফিরে এসেছে মানুষের কথা। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়ামশাহ আবদুল করিমের গানে বারবার ফিরে এসেছে মানুষের কথা। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম‘বন্ধুর বাড়ি এ আত্মায়। গাড়িতে চড়ে আত্মশুদ্ধির সন্ধানে ছুটি। কিন্তু পাই না। রিপু থামিয়ে দেয়। একদিন হয়তো এই গাড়ি পুরোদমে থেমে যাবে। প্রকৃত মালিকের কাছে ধরা দেবে। এই করিমকে তখন মানুষ খুঁজে পাবে শুধুই গানে আর সুরে।’ মৃত্যুর কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে নিজের লেখা ‘গাড়ি চলে না, চলে না’ গানটি প্রসঙ্গে বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম (১৯১৬-২০০৯) এসব কথা বলেছিলেন।
কী অবাক করা বিষয়! ঠিক যে-রকম ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন করিম, তাই যেন এখন কাকতালীয়ভাবে হুবহু মিলে যাচ্ছে! মানুষ ঠিকই এখন করিমকে খুঁজে ফেরে তাঁর গান আর সুরে। ১০০ বছর পেরিয়ে এখনো কত প্রাসঙ্গিক আর সমকালীন তাঁর গান ও দর্শন। প্রতিদিন দেশ-বিদেশে টিভি কিংবা এফএম চ্যানেলে বেজে চলে করিমের গান। নাগরিক ‘ভদ্রজনের’ বাসার ড্রয়িংরুম কিংবা ফুটপাতে চায়ের টংয়ে—সর্বত্র সমানভাবে উপস্থিত করিমের গান। তাঁর জীবন ও কর্মভিত্তিক বইও লেখা হয়েছে বিস্তর। বাংলাদেশ-কলকাতার কয়েক শ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী গেয়েছেন তাঁর গান। ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁর গান কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন ভিনদেশি শিল্পীরাও। এর চেয়ে বড় সমকালীনতা আর কী-ই বা হতে পারে! এটি মাথায় রেখেই হয়তো কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক সিলেটে করিমের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে প্রশ্ন রেখেছিলেন এভাবে: ‘প্রতিভা মানেই বিস্ময়কর, করিম ছিলেন আরও বড় বিস্ময়কর। একই লোক এত আধুনিক এবং এত চিরকালীন হন কীভাবে?’ আর তাঁকে নিয়ে লোকগানের অকালপ্রয়াত শিল্পী কালিকা প্রসাদ বলেছিলেন: ‘তিনি যে গান সৃষ্টি করেছিলেন, তা চিরকালীন। সময়কে ধারণ করে গানের মাধ্যমে বলে গেছেন অকপট সত্য কথা। পৃথিবীতে এমন আরও মানুষ থাকলে পৃথিবীটি বদলে যেত।’
বাংলার ‘লোকায়ত ধারার গানের সর্বশেষ অধীশ্বর’ বলা হয়ে থাকে শাহ আবদুল করিমকে। কিন্তু কেন? সেটা বিশ্লেষণের প্রয়াস নেব করিমের জীবন ও কর্মের দিকে এক পলকে ফিরে তাকাতে তাকাতে: সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধল গ্রামে জন্ম নেওয়া করিম কৈশোরে ছিলেন রাখালবালক, ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন বাউলগানের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে হাওরাঞ্চলের মানুষের চেতনাকে গান গেয়ে জাগ্রত করেছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য। সেই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থেকে শুরু করে সত্তরের নির্বাচন পর্যন্ত সিলেট তথা হাওরাঞ্চলে বিভিন্ন জনসভায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-পর্বের আগে গান গাইতেন করিম। সেসব সভায় বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যেই বলতেন, ‘আমি করিম ভাইয়ের গানের খুবই ভক্ত। শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বেঁচে থাকবেন।’
১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষে কাগমারি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন করিম। সেখানে কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে একমঞ্চে গান গেয়ে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর স্নেহধন্য হয়েছিলেন। ভাসানী সেদিন তাঁকে বলেছিলেন, ‘ব্যাটা, গান ছাড়বে না, সাধনা চালিয়ে যাও। একদিন গণমানুষের শিল্পী হবে তুমি।’ হলোও তাই। শত অভাব-অনটনে করিম যেমন গান আর সাধনা ছাড়েননি, তেমনই তিনি ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছিলেন ‘গণমানুষের শিল্পী’ হিসেবে। নির্লোভ, সততা আর সৎসাহস তাঁকে নিয়ে গেছে এক অন্য উচ্চতায়। লোকায়ত ধারার অন্য গীতিকবিদের চেয়ে তাঁর গানে বৈচিত্র্যের মাত্রা বেশি। একেবারেই সাদাসিধে, কিন্তু অনন্য এক মোহাবিষ্ট মেজাজ তাঁর গানকে দিয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। আবার তর্ক-বিতর্কমূলক মালজোড়া গানেরও একজন বিশিষ্ট শিল্পী তিনি। বিশ শতকের গ্রামীণ এই মনীষী ভাবনা ও চেতনার ক্ষেত্রে কতটা প্রাগ্রসর ছিলেন, সেটা তাঁর প্রায় ৫০০ গানের সংকলন শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র (২০০৯) পাঠেই বোঝা যায়।
শাহ আবদুল করিমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঝুলিতে জমা রয়েছে কেবল আট দিনের অক্ষরজ্ঞান। তাই সংগত কারণেই বুদ্ধ-মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেলিন-স্তালিন-মাওয়ের রচনা পাঠ তো দূরের কথা, তাঁদের জীবনদর্শনের ছিটেফোঁটা জানাও তাঁর পক্ষে অসম্ভব। এ-রকম একজন ব্যক্তি—তা-ও আবার যিনি বাস করতেন প্রত্যন্ত এক অজপাড়াগাঁয়ে—সেই তিনি যখন উচ্চারণ করেন, ‘বড়ো শয়তান সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন ফন্দি আঁটে/মধ্যম শয়তান পুঁজিবাদ বসে বসে মজা লোটে/সামন্তবাদ জালিম বটে, দয়া নাই তাহার মনে॥’ তখন এই শিল্পীর চেতনা, দর্শন ও যাপনগত আত্ম-অতিক্রমের পথটি নিশ্চয়ই গভীরতর বৈচারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনার দাবি রাখে।
এমন উদাহরণের পর এটা বুঝতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয় যেÑকরিম নিছক ‘অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন’ হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতি, সমাজ ও জগৎ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা কাজে লাগিয়ে পরিণত হয়েছিলেন দার্শনিক ও শিক্ষিত ব্যক্তিতে, আর এ কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে সামান্তবাদ–সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ফারাক নির্ণয় করা। আগাগোড়াই তিনি প্রগতি, অসাম্প্রদায়িকতা এবং মুক্তচেতনার পাশাপাশি বলতে চেয়েছেন ভাগ্য-বিড়ম্বিত মানুষের গল্প। এর বাইরে বাউলসাধনা, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, মানুষ-ভজনা, ভক্তিগীতি এবং বিচ্ছেদ গানও রচনা করেছেন। বাউল গান আর গণসংগীতের পাশাপাশি তাঁর রচিত বিচ্ছেদ গানগুলো হালের তরুণদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। রূপকের আড়ালে কঠিন সত্যগুলো সহজভাবে গানে উপস্থাপন করেছেন তিনি—তা সে হোক গণসংগীত, বিচ্ছেদ কিংবা নিগূঢ়তত্ত্বের গান।
বাউলসাধক লালন থেকে শুরু করে হালের লোকায়ত ধারার গীতিকবিদের যেখানে মুষ্টিমেয় কিছু গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেখানে করিমের গানের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় একেবারেই বিপরীত দৃশ্য। বর্তমানে পয়লা বৈশাখের দিন নববর্ষের আয়োজন যেমন ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ ছাড়া জমে না, তেমনই বসন্তের প্রথম দিনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে’–এর পাশাপাশি এখন গীত হয় করিম প্রণীত ‘বসন্ত বাতাসে ও সই গো বসন্ত বাতাসে’। করিমের এ-রকম অন্তত শ খানেক গানের কথা এক নিশ্বাসে বলে দেওয়া যাবে, যেগুলো পেয়েছে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা: ‘মন মজালে ওরে বাউলা গান’, ‘আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া’, ‘মুর্শিদ ধন হে’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল’, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু’, ‘আইলায় না আইলায় না রে বন্ধু’, ‘আমি ফুল, বন্ধু ফুলের ভ্রমরা’, ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে’, ‘মাটির পিঞ্জিরায় সোনার ময়না রে’, ‘আসি বলে গেল বন্ধু আইল না’, ‘কী জাদু করিয়া বন্ধে’, ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী’, ‘রঙের দুনিয়া তোরে চাই না’, ‘তুমি বিনে আকুল পরান’, ‘আমি তোমার কলের গাড়ি তুমি হও ড্রাইভার’—আরও ঢের গানের নাম নেওয়া যাবে।
গ্রামীণ গানের আসর থেকে শুরু করে শহুরে মঞ্চ—সবখানেই আছেন করিম। উপরন্তু তিনি এখন মিশে গেছেন আমাদের জনপ্রিয় ধারার জনসংস্কৃতিতেও। হয়ে উঠেছেন ব্যতিক্রমী এক ‘আইকন’। প্রয়াত সংগীতজ্ঞ মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর একটি বয়ান এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে: ‘একদিকে ঐতিহ্যধারায় সার্থক ধারক-বাহক কবি করিম, অপরদিকে তিনি গণমানুষের, মেহনতি জনতার প্রতিনিধি চারণশিল্পী। এই দুয়ের সমন্বয় করিমকে গড়ে তুলেছে এক ব্যতিক্রমী বাউল কবিরূপে।’
মৃত্যুর কয়েক বছর আগের ঘটনা। করিমের স্মৃতিশক্তি তখন অনেকটাই কমে এসেছিল। তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছেলে শাহ নূরজালালের হাত ধরে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সংবর্ধনায় আয়োজকেরা করিমের হাতে সোয়া ৩ লাখ টাকার চেক তুলে দিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সোয়া ৩ হাজার টাকা! চেক হাতে নিয়ে সে সময় আয়োজকদের উদ্দেশে করিম বলেছিলেন, ‘আপনাদের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। আমার মতো নিতান্তই অভাজন এক ব্যক্তির হাতে আপনারা সোয়া ৩ হাজার টাকা তুলে দিলেন। আপনাদের ভালোবাসার এই অশেষ ঋণ আমি আজীবন মনে রাখব।’ এরপর তাঁকে জানানো হলো টাকার সঠিক পরিমাণ।
টাকার সঠিক পরিমাণ জেনে একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন করিম। ছেলেকে বললেন, ‘চল বাড়ি যাই। সর্বনাশ, এত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমার টাকার দরকার নাই। মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই তো বড়!’ সেদিন করিমের নির্লোভ চরিত্রের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে মিলনায়তনভর্তি মানুষের চোখ ভিজে উঠেছিল। তাঁকে নিয়ে এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। দিনের পর দিন অনাহারে–অর্ধাহারে কাটিয়েছেন, অভাব-অনটন তাঁকে নিষ্পেষিত করে ফেললেও কারও কাছে হাত পাতেননি। তাঁর গান গেয়ে অনেকে বিখ্যাত হয়েছেন, টাকা উপার্জন করেছেন, কিন্তু সেসব তাঁকে ছুঁয়ে যায়নি কখনো। তিনি কেবল বলতেন, ‘আমার গানের বাণী যেন ঠিক থাকে।’
গান গাওয়ার অপরাধে একদিন নিজ গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন শাহ আবদুল করিম। একই কারণে তাঁর স্ত্রী সরলা খাতুন ও প্রিয় শিষ্য আকবরের জানাজা পড়াতে রাজি হননি গ্রামের মসজিদের ইমাম। কিন্তু, অবাক করা বিষয়,Ñতাঁর মৃত্যুর পর সেই গ্রামের মসজিদে অনুষ্ঠিত জানাজায় ঢল নেমেছিল হাজারো শোকার্ত মানুষের। আর নিজের জন্মগ্রাম তো বটেই, এখন যেন সমস্ত বাঙালির কণ্ঠেই বাসা বেঁধেছে করিমের গান। জীবন ও গানের মধ্য দিয়ে ধল গ্রামে শাহ আবদুল করিম এখন যেমন হয়ে উঠেছেন বাংলার, একইভাবে হয়ে উঠেছেন সারা পৃথিবীর—চিরকালের।