জনতার বাণী ডেস্ক,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আহসান খালিদের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত। 👇
“একজন বিচারিক কর্মকর্তার বদলি কি প্রশাসনিক রুটিন বিষয় নাকি শাস্তি?”- এই সওয়ালের উত্তর বা সিদ্ধান্ত সরল কিংবা একরৈখিক নয়। কে- কাকে- কী উপায়ে বদলি করছে সেটির নির্ণয়ের উপর উত্তর নির্ভরশীল। সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি একটি স্বাভাবিক, নিয়মিত ব্যাপার এবং বিবিধ কারণে সেটি কাঙ্ক্ষিতও। কিন্তু একজন জুডিসিয়াল সার্ভিস কর্মকর্তা কি রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তার মতো একই মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের সমতায় অবস্থান করে যে সরকারের যখন যেমন ইচ্ছানুযায়ী বদলি করা যায়?
এক কথায় উত্তর হচ্ছে- না।
সংবিধান বিচারবিভাগকে একটি পৃথক ভাগ (ষষ্ঠ ভাগ) এ সন্নিবেশিত করে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক, স্বতন্ত্র অবস্থান ও মর্যাদা দিয়েছে। নির্বাহী থেকে বিচারবিভাগ যে পৃথক থাকবে সেটি অধুনা কোন ব্যাপার নয়- ১৭৪৮ সালে মন্টেস্কু তাঁর ‘স্পিরিট অব লজ’ বইয়ে এই নির্দেশনা দিয়ে গেছেন যা বর্তমানে বিশ্বের প্রায়সব দেশ স্বীকার করেছে এবং শক্ত ভিত্তিতে সেটি প্রতিষ্ঠিত। ২০০৭ সাল হতে আইনানুযায়ী বাংলাদেশেও বিচারবিভাগ রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ থেকে পৃথক, স্বাধীন। বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাবৃন্দ আলাদা জুডিসিয়াল সার্ভিস বিধিমালা দ্বারা পরিচালিত যার মাধ্যমে নিয়োগ, বদলি, বরখাস্ত, অপসারণ, পদোন্নতি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান এবং বেতন-ভাতাসহ সব মানদণ্ডেই নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জুডিসিয়াল সার্ভিসকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
উপরোক্ত কারনে বিচারিক কর্মকতাদের কর্মস্থল নির্ধারণ,বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক স্বতন্ত্র বিধান সন্নিবেশিত আছে। ১৯৭২ এর মূল সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল নিম্ন আদালতের বিচারকদের তত্ত্বাবধানের এসব দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে থাকবে যা পরবর্তীতে খর্ব করে রাষ্ট্রপতির পরামর্শের বিধান যুক্ত করা হয়।
সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকবে।’ আবার ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন’। অর্থাৎ, বর্তমানে রায়ের ব্যাপারে নিম্ন আদালত স্বাধীন হলেও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট এখনও সরকারের মুখাপেক্ষী রয়ে গেছে।তার মানে আপনাকে সাঁতার কাটার স্বাধীনতাটুকু দেয়া হয়েছে, তবে হাত-পা বাঁধা!
জামিনলাভ অভিযুক্তের আইনি অধিকার। জামিন না পেয়ে সংক্ষুদ্ধ হলে সেই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করার সুযোগ চলমান আইনের বহুল প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত বিধান। কিন্তু সেটির পরিবর্তে জামিন না দেওয়া বিচারককে বদলি এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অধস্তন জজ ভারপ্রাপ্ত হয়ে ঊর্ধ্বতন জজের বিচারিক সিদ্ধান্তকে উল্টে দিয়ে নতুন আদেশ প্রদান- দুটো আইনি জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়ঃ
১- এই বদলি ‘শাস্তিমূলক’ কিনা?
২- নতুন জামিন আদেশ কি আইনগতভাবে বৈধ?
জামিন প্রদান বিচারকের এখতিয়ার, বিচারককে বদলি করা রাষ্ট্রপতির পরামর্শক্রমে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার। দৃশ্যত- এই দুই এখতিয়ারের কোনটির চর্চাই আইনের ব্যত্যয় নয়। পিরোজপুরের ঘটনার পরম্পরা ‘বিচারকের বদলি শাস্তিমূলক’- এই জনধারণাকে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করে, আইন বোদ্ধাদের নিকট এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ন্যায়ানুগতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। একইসাথে আইনের শাসনের সমর্থকদের হাহাকারকে তীব্র করে এই অর্থে যে, আজ মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ টিকে থাকলে আর ঝটিকা বদলির দরকার পড়লে এককভাবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো সুপ্রিম কোর্টই। সরকার কর্তৃক বিচারে হস্তক্ষেপ করার এই যে সাংবিধানিক সুযোগ- এটিকে সমালোচনা ও প্রশ্ন করার নতুন উপলক্ষ উপস্থিত হলো, আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচারবিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পুরাতন দাবিটিও হালে পানি পেল।
প্রথম আলো পত্রিকা মারফত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এই সংক্রান্ত নতুন যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন সেটিও বেশ কৌতুহল উদ্দীপক এবং ২য় প্রশ্নের উত্তর দানে সচেষ্ট করে। তাঁর মতে, ২০০৪ সালের দুদক আইনের ২৮ ধারা বলেছে, দুদকের মামলার বিচার স্পেশাল জজ করবে। সুতরাং নির্দিষ্টভাবে দুদকের মামলায় স্পেশাল জজের এখতিয়ার না থাকা কোনো একজন ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করতে পারেন না। দুদকের মামলা শুনতেই পারেন না। তাই তর্কিত জামিন আদেশটি ‘কোরাম নন জুডিশের’ (যথাযথভাবে আদালত গঠিত না হওয়া) দোষে দুষ্ট।
জামিন প্রদানে গুরুতর ভুল বা অন্যায় হওয়ার কারণেই বিচারকের বদলি হয়েছে- এটি যদি স্থির করা হয় তাহলে মেনে নিতে হবে এই বদলি বিচারকের ‘শাস্তি’। তখন নতুন আইনি বিতর্ক সামনে আসবে- ‘বিচারিক কাজ (Judicial Functions)’ নির্বাহ করতে গিয়ে বিচারকের ভুল বা অন্যায়ের জন্য বিচারককে ব্যক্তিগতভাবে শাস্তি প্রদান আইনগতভাবে বৈধ কিনা! ‘বিচার কার্যের জন্য একজন বিচারক দায়মুক্ত (Personal Immunity for Judicial Functions)’ -এই ধারণা ব্রিটিশ কমন ল, আমেরিকান লিগ্যাল সিস্টেম, ভারত-পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে আইনগতভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। সেক্ষেত্রে বিচারকের শাস্তিমূলক বদলি এই নিয়মের লঙ্ঘন ঘটাবে।
আলোচ্য ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছেন এবং বিচারক বদলির সিদ্ধান্তের বৈধতার প্রশ্নে রুল জারি করেছেন। আশা করছি স্বল্পতম সময়ে তর্কিত আইনি সওয়াল এর জবাব উচ্চ আদালতের তরফে পরিষ্কার হবে।
======================
© সাঈদ আহসান খালিদ
চট্টগ্রাম।