নিউজ ডেস্ক,
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ‘বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচও।
বিবিসি জানিয়েছে, প্রাণঘাতী এ ভাইরাস চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত থাকায় বৃহস্পতিবার এক জরুরি বৈঠকের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ঘোষণা দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহা মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস বলেছেন, “চীনে যা ঘটছে, সেটাই এ সতর্কতা জারির মূল কারণ নয়। অন্য দেশে যা এখন ঘটছে, মূলত সে কারণেই আমরা সতর্কতা জারি করেছি।”
নতুন ধরনের এ করোনাভাইরাস বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে প্রথমত চীনফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে। কিন্তু জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভিয়েতনামে ৮ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, যারা কখনও চীনে যাননি। অর্থাৎ, সেখানে মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে শুরু করেছে এ ভাইরাস।
যেসব দেশে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল, সেসব দেশে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ শুরু হলে পরিস্থিতি কী হবে- মূল সেই ভাবনা থেকেই বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডব্লিউএইচও।
এদিকে চীনে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা এক দিনেই ১৭০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২১৩ জন। নতুন করে দুই হাজার মানুষের দেহে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, কেবল চীনেই আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ৭০০ জনে দাঁড়িয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে দেশটির ন্যাশনাল হেলথ কমিশন।
আর চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে আরও ১৮ দেশে অন্তত ৯৮ জনের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে ডব্লিউএইচও। তবে চীনের বাইরে এ ভাইরাসে কারও মৃত্যুর তথ্য এখন পর্যন্ত আসেনি।
২০১৯-এনসিওভি
২০০২ সালে সার্স এবং ২০১২ সালের মার্সের মতই একই পরিবারের সদস্য নভেল করোনাভাইরাস বা ২০১৯-এনসিওভি। সাধারণ ফ্লুর মতই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়াতে পারে এ রোগের ভাইরাস, ছড়াতে পারে মানুষ থেকে মানুষে।
করোনাভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এর লক্ষণ শুরু হয় জ্বর দিয়ে, সঙ্গে থাকতে পারে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীর ব্যথা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট।
লক্ষণগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মত। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে এ রোগ কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। পরিণতিতে ঘটতে পারে মৃত্যু।
>> করোনাভাইরাস: যা যা জানা দরকার
>> করোনাভাইরাস: নিরাপদ থাকতে যা করতে হবে
>> করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ডব্লিউএইচও’র পরামর্শ
নভেল করোনাভাইরাস এর কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এমন কোনো চিকিৎসা এখনও মানুষের জানা নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। আপাতত একমাত্র উপায় হল, যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন বা এ ভাইরাস বহন করছেন- তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
উহানের প্রথম ৪২৫টি সংক্রমণের ঘটনা বিশ্লেষণ করে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন দেখিয়েছে, আক্রান্তদের গড় বয়স ৫৯ বছর। অর্থাৎ, বয়স্করাই এ ভাইরাসের শিকার হচ্ছেন বেশি। তাদের মধ্যে পুরুষ ৫৬ শতাংশ।
কোনো এক দেশে কোনো রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর তা যদি অন্য দেশে ছড়াতে শুরু করে এবং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরির মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখনই এরকম ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
গত এক দশকে পাঁচবার এরকম আন্তর্জাতিক সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু, ২০১৩ সালে ইবোলা, ২০১৪ সালে পোলিও, ২০১৬ সালে জিকা ভাইরাস এবং ২০১৯ সালে আবারও ইবোলার প্রাদুর্ভাবের কারণে বৈশ্বিক সতর্কতার ঘোষণা আসে।
জেনিভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে মহা মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস বলেন, নতুন করোনাভাইরাসটি যেভাবে ছড়াচ্ছে তা ‘নজিরবিহীন’, আর যেভাবে সেটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে, সেটাও আর ঘটেনি।
মধ্য চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। নিউমোনিয়ার মত লক্ষণ নিয়ে নতুন এ রোগ ছড়াতে দেখে চীনা কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল- সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা। তবে তাদের ধারণা, মানুষের দেহে এ রোগ এসেছে কোনো প্রাণী থেকে। তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে।
এ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চীন সরকার দ্রুত যেসব কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে, তার প্রশংসা করেন তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস। তিনি বলেছেন, বৈশ্বিক সতর্কতা জারির মানে এই নয় যে ডব্লিউএইচও চীনের স্বাস্খ্য ব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। আর এই সতর্কতা জারির ফলে চীনের সঙ্গে ব্যবসা করা বা যাতায়াতেও কোনো সমস্যা নেই।
তবে বিভিন্ন বিমান পরিবহন সংস্থা চীনের পথে ফ্লাইট কমিয়ে দিয়েছে বা বন্ধ রেখেছে। রাশিয়া চীনের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জারি করেছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা।
গুগল, স্টারবাক, ইকিয়া, টেসলার মত আন্তর্জাতিক কোম্পানি চীনে তাদের সব দোকান বা কার্যক্রম বন্ধ রাখছে। বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের চীনে যাতায়াতের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
বিবিসি লিখেছে, চীনে এ ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর মাত্র এক মাস পার হয়েছে এবং এরমধ্যেই প্রায় দশ হাজার মানুষ এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের যেসব দেশে এ ধরনের সংক্রামক ব্যাধি শনাক্তকরণ বা নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই, সেখানে নতুন এই করোসাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে কী ঘটবে, তা নিয়েই বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন।
তাদের ধারণা, তেমন কিছু ঘটলে পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, অনেক দেশে পরিস্থিতি কতটা খারাপ, সেটা বুঝতেই অনেক সময় লেগে যাবে।
চীনের যে প্রদেশ থেকে এই ভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়েছে, সেই হুবেইয়ের বেশিরভাগ এলাকা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে গত দশ দিন ধরে। অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখায় প্রায় ৬ কোটি মানুষকে সেখানে আংশিক বা পুরোপুরি অবরুদ্ধ দশার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।
আরও কয়েকটি বড় শহরে পাবলিক বাস, ট্যাক্সি ও রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ রয়েছে। স্কুল ও দোকানপাটও আপাতত খুলছে না। কিছু জায়গায় পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায়নি।
নতুন এ করোনাভাইরাস বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিকেও বড় ধরনের ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। তার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতেও পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রোলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও নিউ জিল্যান্ড ইতোমধ্যে তাদের নাগরিকদের উহান ও চীন থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। তবে দেশে ফেরানোর পর তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। উহানে থাকা যুক্তরাজ্য ও বাংলাদিশ নাগরিকদের একটি অংশকে শুক্রবার দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।