আপনাকে আমি স্বচক্ষে দেখি নি, আপনার পবিত্র সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয় নি, আপনার কন্ঠস্বর আমি শুনি নি, আপনার আর আমার মধ্যে সহস্র বছরের চেয়েও অধিক সময়ের ব্যবধান। তারপরও আপনি আমার এতো আপন হয়ে গেলেন। যারা বুঝে না একুশ শতাব্দীতে বসবাস করা শত শত কোটি মানুষ মধ্যযুগের আরব সমাজের একজন ব্যক্তির প্রতি এতো টান অনুভব করে কীভাবে? তাদের কেমন করে বুঝাবো, ইয়া রাসুলুল্লাহ(সা:), আপনাকে কেনো এতো ভালোবাসি!
আপনার স্মরণে আজ শতকোটি অন্তর ভালোবাসায় ভরে উঠে। প্রতিটি ক্ষণে পৃথিবীর কোনো না কোনো অঞ্চলে উচ্চারিত হয় আপনার প্রশংসা। অথচ আপনি যখন পৃথিবীর বুকে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে ভূমিষ্ট হলেন, তখন আপনি ছিলেন অনেকটা অসহায়, নিঃসঙ্গ। জন্মের আগেই আপনার পিতা আবদুল্লাহ ফিরে গেলেন আল্লাহর কাছে, বয়স ছয় হতে না হতেই হারালেন মা আমেনাকে। তখনও নি:ষ্পাপ শিশুটি বুঝতে পারছিল না, যে মাকে ঘিরে জীবনের সব কিছু, সে মা চলে যাওয়ার মানে কী? আপনি অসহায় কন্ঠে আপনার মায়ের সেবিকা বারাকাকে জিজ্ঞেস করলেন- মায়ের কী হয়েছে বারাকা? বারাকা, আপনাকে কী করে বুঝাতো, আপনি কী হারিয়েছেন? সে আপনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখল, সে অসহ্য উষ্ণ অশ্রু ধারায় সিক্ত হলো আপনার পবিত্র মুখমন্ডল।
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে যে দাদা আপনার দায়িত্ব নিয়েছিল, সে আবদুল মোত্তালিবও ইন্তেকাল করলেন বছর খানেক পর। আপাত দৃষ্টিতে আট বছরের সেই নি:ষ্পাপ শিশুটি ছিল সবচেয়ে অসহায়, সবচেয়ে একা, বাস্তবে আপনার রব- আপনার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিলেন, এমন এক বিস্ময়কর অভিযান, যার দীপ্ত প্রভা স্থান, কালের বাধা ছেদ করে ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। বহু বছর পর আপনার রব আপনার কাছে আয়াত নাযিল করে বলেন-
“ উজ্জ্বল দিনের কসম এবং রাতের কসম, যখন তা নিঝুম হয়ে যায়।
তোমার রব, তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করেন নি এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও হন নি।
নি:সন্দেহে তোমার জন্য পরবর্তী যুগ, পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো।
আর শীঘ্রই তোমার রব, তোমাকে এতো দেবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে।
তিনি কী তোমাকে এতীম হিসেবে পান নি? তারপর তোমাকে আশ্রয় দেন নি?
তিনি তোমাকে পথ না পাওয়া অবস্থায় পান, তারপর তিনিই পথ দেখান।
তিনি তোমাকে নি:স্ব অবস্থায় পান, তারপর তোমাকে ধনী করেন।
কাজেই এতীমের প্রতি কঠোর হয়ো না, সাহায্য প্রার্থনাকারীকে তিরষ্কার করো না,
আর নিজের রবের নিয়ামত প্রকাশ করো।”
আপনার রব, আপনাকে এ পৃখিবীর বুকে একাকী করে দিয়েছিলেন, যেন তিনি- একমাত্র তিনিই, তাঁর পবিত্র ভালোবাসা আর মমতায় আপনাকে লালন পালন করতে পারেন। কী অপূর্ব সে ভালোবাসা! কী অপূর্ব সে প্রতিপালন! মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা আপনি,কখনও শিরকের ধোঁকার শিকার হন নি, তারুণ্যের সেই যাযাবর সময়েও আপনি ছিলেন সব ধরণের অপকর্ম থেকে দূরে। আপনার চরিত্রে সবাই এতোটাই মুগ্ধ ছিল যে ,আপনার বিশ্বস্থতায় সকলের এতোই আস্থা ছিল যে, তারা আপনাকে নাম ধরে না ডেকে, ডাকতে লাগলেন ‘আল-আমিন’।
বহু বছর পর যখন আপনি সত্যের পথে আহবান করা শুরু করলেন, তখন আপনার বিরোধিতা করা মানুষের অভাব ছিল না, এমন কী তারা আপনাকে হত্যা করারও পরিকল্পনা করেছিল। সে পরিকল্পনাকারীদের ধন সম্পদও আপনারই ঘরে ছিল। তারা যখন আপনাকে হত্যা করতে এসে দেখল, সেখানে আপনি নেই, আপনার পরিবর্তে আলী(রা:) ঘুমিয়ে ছিলেন। আলী(রা:) ই তাদেরকে বলেছিলেন- আপনি তাকে রেখে গেছেন, যাতে তাদের ধন সম্পদ তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। এককথায় যারা আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তাদের বিবেচনায়ও তাদের ধনসম্পদ নিরাপদে রাখার একমাত্র স্থান ছিল আপনারই ঘর।
আপনাকে যারা লোকসম্মুখে মিথ্যুক ও যাদুকর বলেছিল, তাদের মতেও আপনিই ছিলেন আল-আমিন, সবচেয়ে বিশ্বস্থ ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। আপনার চরিত্র ও ব্যবহার এতো মনোমুগ্ধকর ছিল- যে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আপনার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন-“ নি:সন্দেহে আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের চূড়ান্তে।” যাদের সৌভাগ্য হয়েছিল আপনাকে দেখার, তাঁরা কেউ কেউ আপনাকে সূর্যের সাথে, কেউ কেউ চাঁদের সাথে তুলনা করেছেন। তাঁদের শব্দতালিকায় আর কোনো সুন্দর শব্দ থাকলে তাঁরা হয়তো তাই উল্লেখ করতন।
ইয়া রাসুলুল্লাহ(সা:), কীভাবে আপনাকে না ভালোবাসি, যখন আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে। একদিন আপনার চোখে পানি দেখে সাহাবারা জিজ্ঞেস করেছিলেন- কাঁদছেন কেনো! ইয়া রাসুলুল্লাহ(সা:)। আপনি বলেছিলেন- আপনার ভাইদের খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। সাহাবারা বলেছিলেন- তারা কী অপনার ভাই নহে! আপনি বললেন- আপনার ভাই হলো তারা যারা অনেক পরে আসবে এবং আপনাকে না দেখেই বিশ্বাস করবে। সর্বদা আপনার অন্তরে এই চিন্তা ছিল যে, আমাদের পরিণতি কী হবে!
উম্মতি উম্মতি বলে- আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে গিয়েছেন। আজ আমরা আপনার উম্মতের অংশ। বিশ্বজুড়ে আমরা আজ সবচেয়ে অপদস্থ। আপনার উম্মতের অংশ হওয়া গোটা বিশ্বের সম্পদ পাওয়ার চেয়েও মূল্যবান ব্যাপার। আজ আমার মনে যত আশা , যত আকাঙ্খা, যত স্বপ্ন, যত চাহিদা সবকিছু পেয়ে গেলেও নিজেকে এতোটা সৌভাগ্যবান মনে করতাম না যতটা মনে হয় -আজ আপনার উম্মতের একজন হতে পেরে।
ইয়া রাসুলুল্লাহ(সা:), আপনাকে কেনো এতো ভালোবাসি, তাতো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না, তবে যতটুকু ভালোবাসা আপনার প্রাপ্য, ততটুকুতো ভালোবাসতে আপনাকে পারি না। কথায় আপনাকে যতটা ভালোবাসি, কাজেতো তেমন ভালোবাসতে পারি না। বাহ্যিক বিষয়ে আপনার অনুসরণ করতে পারলেও চারিত্রিক দিক থেকেতো আপনার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি না! মুখে আপনার প্রতি সালাত পেশ করলেও কাজে-কর্মে উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে আপনার সম্মানটা রক্ষা করতে পারি না। আমরা আপনার উম্মত হওয়ার যোগ্য নই। কিন্তু আপনার রবতো সবচেয়ে ক্ষমাশীল। আপনি আমাদের যতটুকু ভালোবেসেছেন, তিনিতো আরো বেশি ভালোবাসেন।আমরা আমাদের ভুলসমূহ সম্পর্কে যতটা অবগত, তিনিতো তার চেয়েও বেশী অবগত। আমাদের রবের অনুগ্রহের দিকে তাকিয়ে অন্তরে আপনার প্রতি যতটুকু ভালোবাসা রয়েছে,সেই ভালোবাসার দিকে তাকিয়ে আজ বুকে আশা বেঁধে রই। শীঘ্রই আপনার দেখা পাবো।ইয়া নবীআল্লাহ(সা:), খুব শীঘ্রই হাউসে কাওসারের পাড়ে আপনার হাতে পিপাসা মেটাবো। ইয়া হাবীবুল্লাহ(সা:), জান্নাতের নির্মল বাগানে অনন্তকালের যাত্রায় সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়াব,
ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মুহাম্মদ নূরুন্নবী