বৃষ্টিঝড়া সাঁঝের বেলায় কবিতা লিখার ইচ্ছে জাগল। কিন্তু কিছুতেই কবিতায় শব্দচয়ন করতে পারছি না। তাই চিন্তা করলাম- শিক্ষক হিসেবে নিজেকে যেভাবে দেখতে চাই, তার একটা তালিকা তৈরী করি। তালিকাটি তৈরীতে আমি আমার ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতাকেই সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দেব, মনস্থ করলাম। আপনিও চিন্তা করলে দেখবেন- যেরূপ আচরণ আপনার অসহ্য লাগে, সেরূপ আচরণ আপনার তরফ থেকে সংঘটিত হলে অন্যদেরও খুব একটা ভালো না লাগাটা স্বাভাবিক। ক্লাশে পড়া না শিখে গেলে টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে পিঠে বেতের আঘাত এখনও মন থেকে পুরোয় মুছে যায় নি। শিক্ষকের এহেন কাজে, সেই সময়ে আরেকটি বিষয় আমি অনুধাবন করেছিলাম, যে সকল শিক্ষক/শিক্ষিকার জ্ঞানের পরিসীমা সীমিত, উনারাই বেশী শাস্তি দিতেন। যাতে কেউ ভয়ে কোনো প্রশ্ন করার সাহস না পায়। প্রশ্ন করলেই – কিছুইতো জানোস না বলে শাস্তি দিতেন। জানাতেন কম, পিটাতেন বেশী- এরূপ এক অবস্থা। যাক সেসব কথা- এখন আমি আমাকে যেরূপে চাই, তার একটা তালিকা তৈরি করব, ইনশাআল্লাহ।
শিক্ষাদাতা হিসেবে যা যা করবই-
১.শিক্ষার্থীদের সাথে কল্যাণকর,কোমল,সহজ,স্নেহপূর্ণ ও ভালো আচার-আচরণ করব। শিক্ষার্থীরা যতটুকু জোরে আওয়াজ করলে ষ্পষ্টভাবে শুনবে, ঠিক ততটুকু জোরে পাঠদান করব। যতক্ষণ বুঝবে না, সময় দিয়ে হলেও ধৈর্যের সাথে বার বার বুঝিয়ে দিব।
২. ভুল পড়াবো না, ভুল ব্যাখ্যা দিব না। নিজের মূর্খতা গোপন করার জন্য কোনো প্রতারণার আশ্রয় নিব না। কোনো বিষয় জানা না থাকলে বলব জানি না, পরে জেনে জানাব। নিজের পক্ষ থেকে আন্দাজে কিছু বলব না।
৩. শিক্ষার্থীদের ভুল অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে শুধরিয়ে দিব। ভুলের ফলে জোরে ধমক বা চোখ রাঙাবো না। সবসময় মনে রাখব- শিক্ষাদাতার ধমক শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনে। তারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. শিক্ষাদাতা শাস্তিদাতা নন। ক্লাশে পড়াতে হলে ক্লাশ নিয়ন্ত্রন করতে হয়। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করব- ভালোবাসা ও স্নেহপূর্ণ বাণী দিয়েই শিক্ষার্থীদের বেশী নিয়ন্ত্রন করা যায়। সবসময় মনে রাখব- শিক্ষাদাতা তার শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে পারেন। শাস্তি দিয়ে কখনো শিখানো যায় না। যিনি শাস্তি দেন, তিনি শিক্ষার্থীদের মনে স্থান করে নিতে পারেন না। শিক্ষার্থীরা তাকে মনেপ্রাণে অপছন্দ ও ঘৃণা করে।
৫. শিক্ষাদাতা হিসেবে খুবই কোমল নয়নে শিক্ষার্থীদের দেখব ও আন্তরিক পিতৃমাতৃসুলভ ভালোবাসায় তাদেরকে শিক্ষা দিব। শিক্ষাদাতা হিসেবে নিজের ছেলেমেয়েদের যেভাবে সম্বোধন করি, ঠিক সেরূপে শিক্ষার্থীদের সম্মোধন করব। শিক্ষার্থীদের রুচি, যোগ্যতা এবং মেজাজের প্রতি লক্ষ্য রেখে কথা বলব। শিক্ষার্থীদের দেহমনে সজীবতা ও অনুপ্রেরণা বহাল রাখার জন্য বৈধ পন্থায় তাদেরকে কিছু সময় আনন্দ ফুর্তির সুযোগ দিব।
৬. শিক্ষাদাতা হিসেবে নিজেকে জ্ঞানের জাহাজ না ভেবে নিজেও একজন আদর্শ শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে মনে করব। শিক্ষার্থীকে পড়ানোর পূর্বে শিক্ষাদাতা হিসেবে আমি নিজেও ভালোভাবে পড়ে যাব। আমি বিশ্বাস করি- শিক্ষাদাতা একজন আদর্শ পরিশ্রমী ছাত্র। শিক্ষাদাতা কেবল একজন বক্তা নন বা তিনি একজন বিচারক নন। তিনি সে, যিনি যে বিষয়টি পড়াচ্ছেন তাতে তার অভিজ্ঞতা আছে এবং যাদের পড়াচ্ছেন তাদের হয়তও ঐরূপ অভিজ্ঞতা নেই।
৭. শিক্ষার্থীদের মেধাগত ধারণ ক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের জন্য বিষয়বস্তু নির্বাচন ও উপস্থাপন করব। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের উন্নতি ও বিশুদ্ধতা যাচাই বাছাইয়ের জন্য মাঝে মাঝে মূল্যায়ণ পরীক্ষা নিব। শিক্ষার্থীদের মেধা ও স্মৃতি বর্ধনের কোনো কৌশল ও পন্থা জানা থাকলে তাদেরকে অবহিত করব।
সবশেষে যে কথা স্মরণ রাখব- শিক্ষকতা পেশা মহান প্রভু প্রদত্ত এক দায়িত্ব। শিক্ষক/শিক্ষিকা কোনো বেতনভুক্ত কমৃচারী নন। তাঁর পারিশ্রমিককে বেতন বলা হয় না, তা হলো সম্মানী। শিক্ষকতা পেশা কোনো শখ নয়, সেটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত কাজ এবং তাঁর উপর অর্পিত আসমানী দায়িত্ব। শিক্ষাদাতা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজের সন্তানের মতো দেখবেন। অন্তত যারা শিক্ষার্থীকে পরের সন্তান মনে করে তারা আর যা হোক আদর্শ শিক্ষক/শিক্ষিকা নন।
আমি পরিষ্কারভাবে জানি এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি- সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শিক্ষার্থীদের সাথে মিশতেন, তখন এমন স্বাভাবিকভাবে তাদের সাথে মিশে যেতেন যে, অপরিচিত কেউ এসে বুঝার উপায় ছিল না,“ কে শিক্ষক, কে ছাত্র।”
মুুহাম্মদ নূরুন্নবী