এসএসসি ২০২৫: অধীর অপেক্ষার অবসান, বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে ফলাফল; যেভাবে জানবেন আপনার ফল

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে ২০২৫ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল। আগামী ১০ জুলাই, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় একযোগে এই ফলাফল প্রকাশ করা হবে। মঙ্গলবার, ৮ জুলাই, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে ।  

এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল দেশের ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ—এই ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসহ মোট ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রকাশিত হবে । এই ঘোষণা লাখ লাখ পরীক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা ও একই সাথে কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে এসেছে। সাধারণত, লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের একটি বাধ্যবাধকতা থাকে। গত ১৩ মে লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছিল, সেই হিসেবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ফল প্রকাশ করা হচ্ছে ।  

ফলাফল প্রকাশের তারিখ ও সময় নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যে ধারাবাহিক ও অভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে, তা শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সুসংগঠিত যোগাযোগ ব্যবস্থারই প্রতিফলন। যুগান্তর, সময়ের আলো, জাগোনিউজ২৪, ইত্তেফাক, এনটিভি, একুশে টিভি, আমার বার্তা, বিডি প্রতিদিন—সব ক’টি নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম একই তারিখ ও সময় উল্লেখ করেছে, যার উৎস একই সরকারি বিজ্ঞপ্তি। এই অভিন্নতা জনসাধারণের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের তারিখ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি বা জল্পনা-কল্পনার সুযোগ রাখছে না, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিক্ষা বোর্ডের একটি সুসংহত এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারের কৌশলকে নির্দেশ করে, যা একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

ফলাফল জানার সহজ উপায়
শিক্ষা বোর্ডসমূহ জানিয়েছে, এবারের ফলাফল জানার পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি । পরীক্ষার্থীরা পূর্বের ন্যায় অনলাইন এবং এসএমএস উভয় মাধ্যমেই তাদের ফলাফল জানতে পারবে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা কোনো পত্রিকায় ফলাফল পাওয়া যাবে না । এটি ফলাফলের তথ্য বিতরণে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতাকেই তুলে ধরে।  

ফলাফল বিতরণের ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট ডিজিটাল রূপান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে ফলাফল না দিয়ে শুধুমাত্র অনলাইন ও এসএমএস-ভিত্তিক পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে । এই পরিবর্তন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এর ফলে শিক্ষার্থীরা যেকোনো স্থান থেকে দ্রুত তাদের ফলাফল জানতে পারবে, যা শিক্ষা বোর্ড কার্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিড় কমাতে সাহায্য করবে। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার গুরুত্বও বাড়িয়ে তোলে এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ডিজিটাল সেবার প্রতি সামগ্রিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।  

অনলাইনে ফলাফল জানার পদ্ধতি
শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত ওয়েবসাইট www.educationboardresults.gov.bd ভিজিট করে তাদের ফলাফল জানতে পারবে । ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষার নাম (SSC/Dakhil/Vocational), পরীক্ষার বছর (২০২৫), নিজ নিজ শিক্ষা বোর্ড, রোল নম্বর এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর নির্বাচন করতে হবে। এরপর ক্যাপচা পূরণ করে ‘সাবমিট’ বাটনে ক্লিক করলেই ফলাফল প্রদর্শিত হবে । ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা  

www.dhakaeducationboardresults.gov.bd ওয়েবসাইটেও ফলাফল দেখতে পারবে ।  

এসএমএসের মাধ্যমে ফলাফল জানার পদ্ধতি
মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও শিক্ষার্থীরা তাদের ফলাফল জানতে পারবে। এক্ষেত্রে বোর্ডের ধরন অনুযায়ী এসএমএস ফরম্যাটে সামান্য পার্থক্য রয়েছে । ফলাফল প্রকাশের সাথে সাথেই প্রি-রেজিস্ট্রেশন করা নম্বরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফল পৌঁছে যাবে ।  

নিচে দেওয়া হলো “এসএমএসের মাধ্যমে ফলাফল জানার পদ্ধতি” একটি টেবিল আকারে সাজানোভাবে:

বোর্ডের ধরন এসএমএস ফরম্যাট উদাহরণ যে নম্বরে পাঠাবেন
সাধারণ বোর্ড (General Board) SSC বোর্ডের সংক্ষিপ্ত নাম রোল নম্বর সন SSC DHA 123456 2025 16222
মাদ্রাসা বোর্ড (Madrasa Board) Dakhil বোর্ডের সংক্ষিপ্ত নাম রোল নম্বর সন Dakhil MAD 123456 2025 16222
কারিগরি বোর্ড (Technical Board) SSC TEC রোল নম্বর সন SSC TEC 123456 2025 16222

Export to Sheets
প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ফলাফল ডাউনলোড
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব EIIN (Educational Institute Identification Number) ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ওয়েবসাইট অথবা www.educationboardresults.gov.bd থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ ফলাফল শীট ডাউনলোড করতে পারবে । শিক্ষার্থীদেরকেও নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ফলাফল সংগ্রহ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ।  

ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন প্রক্রিয়া
যেসব শিক্ষার্থী তাদের ফলাফলে অসন্তুষ্ট বা মনে করেন মূল্যায়নে কোনো ত্রুটি হয়েছে, তাদের জন্য ফল পুনর্নিরীক্ষণের সুযোগ থাকছে। আগামী ১১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত এই আবেদন গ্রহণ করা হবে । পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন শুধুমাত্র টেলিটক মোবাইল অপারেটরের সংযোগ ব্যবহার করে এসএমএসের মাধ্যমে করা যাবে । প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত ফি প্রযোজ্য হবে। আবেদন ফরম্যাট এবং বিস্তারিত নিয়মাবলী ফলাফল প্রকাশের দিন টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে ।  

ফলাফল প্রকাশের পরপরই পুনর্নিরীক্ষণের আবেদনের সময়সীমা ঘোষণা করা, শিক্ষা বোর্ডগুলোর একটি সক্রিয় পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। এই ব্যবস্থাটি শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ নিরসন এবং মূল্যায়নের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে যে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য অসন্তুষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছেন এবং একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিকারমূলক প্রক্রিয়া প্রস্তুত রেখেছেন। এটি পরীক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থা বাড়াতে সাহায্য করে এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

এসএসসি ফলাফলের গুরুত্ব ও পরীক্ষার্থীদের প্রতি বার্তা
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রায় ১৪ লাখ ৯০ হাজার ১৪২ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে । এই বিশাল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর জন্য এসএসসি পরীক্ষা তাদের শিক্ষাজীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা তাদের উচ্চশিক্ষা ও ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের পথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে । বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক—এই তিনটি বিভাগ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নির্মাণে ভিন্ন ভিন্ন পথ তৈরি করে ।  

তবে, এটি মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে পরীক্ষার ফলাফলই একজন ব্যক্তির যোগ্যতা বা সম্ভাবনার একমাত্র মাপকাঠি নয় । সমাজ, পরিবার এবং এমনকি শিক্ষাব্যবস্থা প্রায়শই ফলাফলের ওপর অযৌক্তিক গুরুত্ব আরোপ করে, যা শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নিজেও শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে এই বছর পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি কর্তৃপক্ষের সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে ।  

সফলতার সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। এটি শুধু জিপিএ-৫ প্রাপ্তি নয়, বরং নিজেকে এবং নিজের কাজকে সম্মান করা, অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং জীবনের প্রতি ভালোবাসা বজায় রাখা । জীবন একটি দীর্ঘ যাত্রা, আর পরীক্ষার ফলাফল সেই যাত্রার একটি ক্ষুদ্র ঘটনা মাত্র । তাই, যারা কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে পারেনি, তাদের হতাশ না হয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীই তার নিজস্ব মেধা ও সম্ভাবনা নিয়ে অনন্য, এবং একটি পরীক্ষার ফল তাদের সমগ্র জীবনের পথ নির্ধারণ করে না।  

গত কয়েক বছরের ফলাফলের একটি তুলনামূলক চিত্র
২০২৫ সালের ফলাফলের পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনও আসেনি, তবে বিগত বছরগুলোর ফলাফল একটি তুলনামূলক ধারণা দিতে পারে। এটি শিক্ষাব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি এবং শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক পারফরম্যান্সের প্রবণতা বুঝতে সাহায্য করে।

২০২৩ সালের এসএসসি ফলাফল:
২০২৩ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৮০.৩৯ শতাংশ । মোট জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন বা ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন শিক্ষার্থী । জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের মধ্যে ৭৯ হাজার ৭৬২ জন ছাত্র এবং ১ লাখ ৩ হাজার ৫৭৮ জন ছাত্রী ছিল । মাদ্রাসা বোর্ডের দাখিল পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৮২.২২ শতাংশ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাসের হার ছিল ৮৪.৭ শতাংশ । ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা উভয়ই হ্রাস পেয়েছিল ।  

২০২২ সালের এসএসসি ফলাফল:
২০২২ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় মোট ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল । এই বছর গড় পাসের হার ছিল ৮৭.৪৪ শতাংশ । ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৮.১০ শতাংশ । মোট ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিল, যার মধ্যে ১ লাখ ২১ হাজার ১৫৬ জন ছাত্র এবং ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৬ জন ছাত্রী ছিল । মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮২.২২ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ৮৯.৫৫ শতাংশ । এই বছর ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি, তবে ২ হাজার ৯৭৫টি প্রতিষ্ঠানে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছিল ।  

বিগত বছরগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২৩ সালে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা উভয়ই ২০২২ সালের তুলনায় কমেছে । এই প্রবণতা পরীক্ষার কাঠিন্য বৃদ্ধি, মূল্যায়ন পদ্ধতির কঠোরতা, অথবা শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে। এছাড়াও, একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো, উভয় বছরেই ছাত্রীদের জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ছাত্রদের তুলনায় বেশি ছিল । এটি শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রীদের শক্তিশালী অংশগ্রহণ এবং সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-শিক্ষাগত দিক, যা ভবিষ্যতে আরও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এই তুলনামূলক চিত্রটি কেবল তথ্য প্রদান করে না, বরং শিক্ষাগত ফলাফলের প্রবণতা এবং এর পেছনের সম্ভাব্য কারণগুলো নিয়ে গভীর আলোচনার সুযোগ তৈরি করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here