দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি ভোট। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়নপত্র যাচাই করবেন ১-৪ ডিসেম্বর। যাচাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ও নিষ্পত্তি হবে ৫-১৫ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ এবং আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বর। প্রচার চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। বুধবার সন্ধ্যায় নির্বাচন ভবনের নিজ কার্যালয়ে বসে ‘বাংলাদেশ বেতার’ ও ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি)’ জাতির উদ্দেশে সরাসরি ভাষণের মাধ্যমে সিইসি এ তফশিল ঘোষণা করেন। এ সময় নির্বাচন ভবন ঘিরে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা তিন স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে। ভাষণের সময় অন্য নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিইসির কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন।

নির্বাচন প্রশ্নে সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যেই এ তফশিল ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন। যদিও সিইসি দাবি করেছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি এই নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেছেন। তার ভাষণেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকার বিষয়টি উঠে আসে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাববিস্তার করতে পারে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে সমাধান খোঁজার আহ্বান জানান। এদিকে তফশিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করেও বিপরীতমুখী কর্মসূচি নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তফশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। তফশিলের প্রতিবাদে আজ আধাবেলা হরতালের কর্মসূচি দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ইসি অভিমুখে গণমিছিল কর্মসূচি নিয়ে এগোলো শান্তিনগরে পুলিশ তাদের আটকে দেয়।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। তিনি সব দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সর্বদা স্বাগত জানাবে। পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয় বলেও মন্তব্য করেন।

এর আগে বুধবার বিকালে নির্বাচন ভবনে সিইসির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল চূড়ান্ত করা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় অন্য নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন। রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকের পরপরই তফশিল ঘোষণা করেন। তফশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত তার রুম থেকে নির্বাচন কমিশনার ও কর্মকর্তাদের কেউ বের হননি। এদিন বেলা ১টা ৮ মিনিটে তিনি ইসি সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। সিইসির আগেই অন্য নির্বাচন কমিশনাররা ইসিতে আসেন। এদিন সিইসি, নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একসঙ্গে দুপুরের খাবার খান। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানও সেখানে অংশ নেন। তফশিল ঘোষণার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশেষ নিরাপত্তা নিয়ে সিইসি নির্বাচন কমিশন ত্যাগ করেন।

সিইসির তফশিল ঘোষণার পর ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, প্রচার শুরুর পর থেকে সব ধরনের সমতল অবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করতে পিছপা হবে না। বিএনপিসহ যেসব দল নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে, সেসব দলের বিষয়ে কমিশন সভায় আলোচনা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত বিধায় সভায় আলোচনাই হয়নি।

তফশিল ঘোষণার পরপরই রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গত নির্বাচনের মতো এবারও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জেলা প্রশাসক ৩০০ আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। যদিও ইসির সঙ্গে সংলাপে বিশিষ্টজনরা প্রশাসন ক্যাডারের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। তবে ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার মধ্যে ৫৬ জন ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মধ্যে ৪৯৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বাকি ৪১ জন সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা রয়েছেন।

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৯০ দিনের ক্ষণগণনা ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা আছে। নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার ২২ দিন আগেই ভোটগ্রহণের তারিখ ঘোষণা করল কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন। ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাতে সময় রেখে তফশিল ঘোষণা করেছিল কেএম নূরূল হুদার কমিশন। ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর ঘোষিত ওই নির্বাচনের তফশিলে একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় ১২ নভেম্বর পুনঃতফশিল করে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ইসির কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে এবারও পুনঃতফশিলের সুযোগ আছে। সংবিধান অনুযায়ী, ২৮ জানুয়ারির আগে যে কোনো দিন পর্যন্ত ভোটগ্রহণ করা যাবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল কবে ঘোষণা হবে-এ নিয়ে রাজনীতি, কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা ও কৌতূহল ছিল। তফশিল ঘোষণার বিষয়েও নির্বাচন কমিশন কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে। সাধারণত জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ আগে রেকর্ড করে বিটিভি ও বেতারে সম্প্রচার করা হতো। এতে আগেভাগেই তফশিল ঘোষণার দিনক্ষণ অনুমান করা সম্ভব হতো। কিন্তু এবার তফশিল ঘোষণার বিষয়টি গোপন রাখতে গিয়ে সিইসির বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচারের দিকে এগোয় ইসি। অবশ্য বুধবার সকাল ১০টায় নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তফশিল ঘোষণার সময় সাংবাদিকদের জানান। ইসির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর অংশীজনদের সঙ্গে সভা করে একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ অনুযায়ী তারা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় বুধবার বিকাল ৫টায় সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত ২৬তম কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সিদ্ধান্ত হয় সন্ধ্যা ৭টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে সরাসরি ভাষণ দেবেন। সেই ভাষণেই তফশিল ঘোষণা হবে।

রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে ইসির পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমরা বিব্রত হই। এটা রাজনৈতিক ইস্যু। আমরা বারবার বলছি, নির্বাচন কমিশন মনে করে তফশিল ঘোষণার মতো পরিবেশ আছে। তফশিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলো প্রচার শুরু করতে পারবেন কি না-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে ভোটগ্রহণের আগের ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রচার চালাতে পারবে।

নির্বাচন ভবন ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা : তফশিল ঘোষণা উপলক্ষ্যে নির্বাচন ভবন ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচন ভবনের বাইরের সড়কে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্য মোতায়েন করা হয়। পুলিশের এপিসি ও জলকামানের গাড়িও সেখানে রাখা হয়। নির্বাচন ভবনের সামনের রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নির্বাচন ভবনের ভেতরে পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্য রাখা হয়। কমিশনে প্রবেশেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।

বুধবার দুপুরে নিরাপত্তাব্যবস্থা ঘুরে দেখেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গেও দেখা করেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিরাপত্তা নিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, টোটাল সিকিউরিটি দেখার জন্য এখানে এসেছিলাম। নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা করা দরকার, তা করবে পুলিশ। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তফশিল ঘিরে নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য নগরবাসীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য যেসব কাজ পুলিশের করা দরকার তা করবে। বিশেষ সিকিউরিটি চেকআপ, নিরাপত্তা তল্লাশি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার জন্য এসেছি। আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য হলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি। শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্ন হলে কঠোর অবস্থান নেবে পুলিশ। আর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হলে পুলিশ তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে।