কবিগান ভুবনের কিংবদন্তি নায়ক ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক গানে নবজীবনের পরশর্দাতা কবিয়াল রমেশ শীল। কবিগানকে যিনি অপসংস্কৃতির অবক্ষয় থেকে বাঁচিয়ে গণ-মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে তিনি রূপান্তর করেছেন।
রমেশ শীল ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার গোমদী গ্রামে জন্মগ্রাহণ করেন। তার পিতার নাম চীচরণ শীল। চীচরণ শীল পেশায় নাপিত ও কবিরাজ ছিলেন। প্রথম স্ত্রী ছিলেন অপূর্ববালা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী অবলাবালা। তার চার পুত্র ও এক কন্যা সন্তান। শৈশবে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই কবিগানের আসরে গান শুনতে যেতেন রমেশ শীল। কবিগানের লড়াই তাঁকে ভীষণ টানতো। কখনো কখনো তাঁর বাড়ির উঠোনেই বসতো গানের লড়াই। মুগ্ধ হয়ে শুনতেন আর মুখস্থ করে মুখে মুখে গাইতেন। এগার বছর বয়সে চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে পিতার মৃত্যুর পর স্কুলজীবনের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সকল দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। কিছুদিন পিতার পেশা চালানোর পর আর্থিক সংকটের কারণে জীবিকা নির্বাহের জন্য বার্মার রেঙ্গুন শহরে যান। সেখানে দোকানে চাকরি নেন এবং পরবর্তীতে একটি দোকানের মালিক হন তিনি। কিন্তু স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার দরুন নিজের গ্রামে পুনরায় ফিরে এসে তিনি পূর্বের নরসুন্দর কাজের পাশাপাশি কবিরাজ হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৮৯৭ সালে প্রথম মঞ্চে কবিগান পরিবেশন করেন এবং সমাদৃত হন। ১৮৯৯ সালে কবিগান পরিবেশনায় প্রতিদ্বন্দী তিনজন কবিয়ালকে পরাজিত করলে উদ্যোক্তা ও শ্রোতাকুলের কাছ থেকে তিনি মোট তের টাকা সম্মানি লাভ করেন, যা পেশা হিসেবে পরবর্তিকালে কবিগানকে বেছে নিতে রমেশ শীলকে অনুপ্রাণিত করে।
১৯৩৮ সাথে বাংলা কবিগানের ইতিহাসে প্রথম ‘রমেশ উদ্বোধন কবি সংঘ’ সমিতি গঠন করেন তিনি। ১৯৪৪ সালে কবি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘নিখিল বঙ্গ প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সম্মেলন’ উপলক্ষে আয়োজিত কবির লাড়াইয়ের আসরে শেখ গুমানীকে পরাজিত করে শ্রেষ্ঠ কবিয়ালের মর্যাদা লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। যে কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়ার পরে অন্যান্য নেতা-কর্মীর সাথে রমেশ শীলকেও গ্রেফতার করা হয়। তাঁর ‘ভোট রহস্য’ পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার। কবি দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন এসময়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করায় রমেশ শীলের সাহিত্য ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি তাঁকে শ্রেষ্ঠ লোককবির সম্মানে ভূষিত করেন।
পূর্বে কবিগান ছিল কেবল চিত্তবিনোদনের মাধ্যম মাত্র, কিন্তু রমেশ শীল একে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারে পরিণত করেন। প্রগতিশীল ধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে কবি সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেন। এতে কবিগানের বিষয় বস্তুতে নিয়ে আসে আমুল পরিবর্তন। যুদ্ধ-শান্তি, চাষী-মজুদদার, মহাজন-খাতক, স্বৈরতন্ত্র-গণতন্ত্র এসব হয়ে যায় কবিগানের উপজীব্য বিষয়।
রমেশ শীল মাইজভান্ডারী তরিকার আধ্যাত্মিক গানের অন্যতম রূপকার ছিলেন। চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারী তারিকার আধ্যাত্মিক মহিমা তুলে ধরে তিনি বহু গান রচনা করেন। তাঁর চেতনায় মাইজভান্ডারের ভাব ধারা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তিনি মাইজভান্ডারী তরিকারও অনুসারী ছিলেন। তাঁর রচিত ‘চলরে মন ত্বরাই যাই, বিলম্বের আর সময় নাই/ গাউছুল আজম মাইজভা-ারী স্কুল খুলেছে’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর এ ধারার গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ।
রমেশ শীল প্রকৃত দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্ত মনের অধিকারী ছিলেন। ‘হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকল ধর্মের এক কথা’, ‘মাটির মূর্তির পূজা ছেড়ে মানুষ পূজা কর’ এসব তাঁরই সাহসী উক্তি। তাছাড়া দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর কথা, সুর, গান, কবিতা ও লেখনি ছিল রণতূর্যের মতো। তাঁর গণসঙ্গীত দেশের মানুষদের এই সব সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
রমেশ শীল রচিত পুস্তকের মধ্যে আশেকমালা, শান্তিভান্ডর, নূরে দুনিয়া, ভান্ডারে মওলা, জীবন সাথী, মুক্তির দরবার, জীব সাথী, সত্যদর্পণ, এস্কে সিরাজিয়া, দেশের গান, ভোট রহস্য, চট্টল পরিচয়, মানব বন্ধু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি ‘রমেশ শীল রচনাবলী’ প্রকাশ করে।
কবিয়াল রমেশ শীল জীবনের শেষ দুই দশকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি প্রচুর সংখ্যক সংবর্ধনার দ্বারা সম্মানিত হন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। ১৯৫৮ সালের ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে সহবন্দীদের আয়োজিত জন্মদিনের সংবর্ধনা, ১৯৬২ সালের ঢাকার বুলবুল একাডেমি প্রদত্ত সংবর্ধনা, ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামের নাগরিক সংবর্ধনাসহ প্রভৃতি সংবর্ধনা অর্জন করেন।
রমেশ শীল ছিলেন একদিকে সমাজ সচেতন মানবিক চিন্তা ও চেতনার মানুষ, অন্যদিকে গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এক সংগ্রামী সৈনিক। যার ফলে তিনি কবিগানে নিয়ে এলেন সমসাময়িক বিষয়। বাংলার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে কবিয়াল রমেশ শীল আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। কবিগানের লোকায়ত ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক সমাজ সচেতনতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। লোককবির মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here