আস্থার সংকটে ভুগছে রাজনৈতিক দলগুলো। ঘরে-বাইরে কেউ ছাড় দিতে নারাজ। এমনকি কেউ কারও কথায় আস্থাও রাখতে পারছে না। একই অবস্থা তাদের জোটে থাকা শরিক দলগুলোর মধ্যেও।

প্রায় ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সংবিধানের ভেতরে থেকে দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। তবে এই নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে বড় বাধা দলটির অভ্যন্তরীণ বিরোধ। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল-সর্বত্রই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা একে অপরের মুখোমুখি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও স্বস্তিতে নেই। চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বসহ টানাপোড়েন চলছে তাদের মধ্যে। নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠপর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের বিরোধের বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করেছে।

অন্যদিকে দীর্ষদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা মাঠের বিরোধী দল বিএনপি বর্তমান সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে রাজপথে বেশ সরব। এরমধ্যেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বিরোধ এই দলটিকে বেশ ভোগাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মতোই কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীরাও মুখোমুখি নিজেরা নিজেদের। বিএনপির পাশে থেকে তাদের বলয়ে থাকা আরও ৩৬টি রাজনৈতিক দল একদফা দাবিতে যুগপৎভাবে কর্মসূচি পালন করছে। কিন্তু এসব কর্মসূচি ঠিক করার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা চলছে তাদের ভেতরে। ফলে ঘরে-বাইরে আস্থার সংকটে ভুগছে বিএনপি এবং তাদের শরিকরাও।

প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বুধবার বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকে, আছে, থাকবেও। এটা কোনো সমস্যা নয়। নির্বাচনের সময় সবাই ঐক্যবদ্ধভাবেই নৌকার পক্ষে কাজ করবে। অতীতেও তাই হয়েছে। তাই এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আস্থার অভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই জোট একটি আদর্শিক জোট। আদর্শগত বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোনো অমিল নেই। আস্থার সংকটও নেই। আগামী নির্বাচন আমরা ১৪ দলগতভাবে করব-এটি চূড়ান্ত। তাই আমাদের মধ্যে আস্থাহীনতার কোনো সুযোগ নেই।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি এখন বর্তমান সরকার পতনের আন্দোলনকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে আছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকব। আমাদের মধ্যে বিভেদ বিরোধের বিষয়টি ঠিক নয়।

সরকারবিরোধী কর্মসূচি দেওয়ার ক্ষেত্রে সমমনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করা এবং সমন্বয়হীনতার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটিও যেভাবে বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে এটি এক ধরনের অপপ্রচার। আমরা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেই কর্মসূচি দিচ্ছি। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের দিন দিন সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এবং দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে সরাসরি দায়ী করে সম্প্রতি বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম।

এতে ক্ষুব্ধ ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জাসদ। হাসানুল হক ইনুর নির্বাচনি এলাকা কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতাকর্মীরা এখন মুখোমুখি। ঢাকার-৮ আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এই আসনে আগামী নির্বাচনে আর ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগ নেতারা। এতে ক্ষুব্ধ ওয়ার্কার্স পার্টি।

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ এবং তরিকত ফেডারেশনকে আসন ছাড় দেয়। বিকল্পধারা বাংলাদেশ বাদে বাকি সবাই ১৪ দলে আছে। আগামী নির্বাচনে এই দলগুলোকে কয়টি আসন দেওয়া হবে, তা এখনও পরিষ্কার করে বলেনি আওয়ামী লীগ। এতে করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে অসুবিধা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, নির্বাচনের আর বেশি সময় আমাদের হাতে নেই। তাই এখনই একটি রোডম্যাপ তৈরি করা উচিত।

আওয়ামী লীগসহ তাদের শরিক ১৪ দলের মতোই আস্থাহীনতায় ভুগছে বিএনপি এবং তাদের শরিক সমমনা দলগুলো। সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠের রাজনীতিতে বেশ সরব এবং সক্রিয় থাকলেও বিএনপির ভেতরের চিত্র খুব একটা আশাপ্রদ নয়। বিভিন্ন যায়গায় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। দ্বন্দ্ব, সংঘাত, পালটাপালটি কর্মসূচি পালন, অভ্যন্তরীণ বিবাধ বিএনপির নিত্যসঙ্গী। দলটির দীর্ঘদিনের সুহৃদ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও সম্পর্ক অম্লমধুর-এই ভালো তো, এই খারাপ। বাকি শরিকরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎভাবে রাজপথে থাকলেও কর্মসূচি ঠিক করার ক্ষেত্রে তারা থাকেন শতভাগ অন্ধকারে।

বিএনপির শরিক একটি দলের শীর্ষ নেতা এ প্রসঙ্গে বুধবার বলেন, বিএনপি মুখে বলছে সবাইকে নিয়ে তারা বর্তমান সরকারের পতন ঘটাবে। বাস্তবে তারা ‘একলা চলো’ নীতিই অবলম্বন করছে। ওই নেতার দাবি, শরিকদের কোনো মতামত আমলে নেয় না বিএনপি। বড় দল হিসাবে তারা তাদের একক সিদ্ধান্তই অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। যা একে অপরের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং আস্থাহীনতার সুযোগ সৃষ্টি করছে।