১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার পতন আন্দোলনসহ সব আন্দোলনেই শিক্ষার্থীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু দেশের ছাত্রসংগঠনগুলোতে ছাত্রীদের অবস্থান এখন পর্যন্ত ততটা শক্ত নয়। মিছিলের সামনের সারিতে ছাত্রীদের পদচারণ থাকলেও ছাত্রসংগঠনের কমিটি ও নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে ছাত্রদের আধিপত্যই দেখা যায়। কমিটিতে যে নারীরা থাকেন, তাঁদেরও দেওয়া হয় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদ।
দেশের বড় দুটি ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এবং ছাত্রদল বিএনপির ছাত্রসংগঠন বলেই পরিচিত। গত ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে ছাত্রদলের ষষ্ঠ কাউন্সিল। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন মোট ২৮ জন, যাঁদের মধ্যে একজন নারী প্রার্থী ডালিয়া রহমানকে নিয়ে সংগঠন ও সংগঠনের বাইরে আলোচনা ছিল। ২৭ বছর আগে ১৯৯২ সালে প্রথমবার অনুষ্ঠিত ভোটে এই দুটি পদের কোনোটিতেই কোনো নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করেননি।
ছাত্রদলের চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে দেশের অন্যতম বড় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। এই সংগঠনে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদে কখনো কোনো নারী আসেননি। তবে মারুফা আক্তার পপি ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আর দলটির দায়িত্বশীল পদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছাত্রীরা এসেছেন। অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের মধ্যে বাম ছাত্র সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের উপস্থিতি প্রায়ই দেখা যায়। অবশ্য ছাত্র রাজনীতি করে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন, এমন নেতার সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। বর্তমান সংসদে ছাত্ররাজনীতি করে সরাসরি সাংসদ হিসেবে আসা নারীর সংখ্যাও হাতে গোনা।
মারুফা আক্তার পপি বললেন, রাজনীতির পথটা তো মসৃণ নয়। এখানে ‘ডেডিকেশন’ থাকতে হয়। ছাত্রীরা রাজনীতিতে আসতে চাচ্ছেন। তবে এটা ঠিক যে কমিটিগুলোতে সেভাবে ছাত্রীদের দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে এই সমস্যা কেটে যাবে।
ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চারজন সাবেক নেত্রী বললেন, তাঁদের নিজ নিজ সংগঠন থেকে উঠে আসা কোনো নেত্রী রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান পেয়েছেন, তা দেখা যায় না। একমাত্র ছাত্রলীগের মারুফা আক্তার পপি তাঁর সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ছাত্রদলের এমন কেউ নেই। জাতীয় রাজনীতিতেও এ দুটি সংগঠনের কোনো নেত্রীর উপস্থিতি সেভাবে নেই। ফলে যাঁরা নতুন করে ছাত্ররাজনীতিতে আসছেন, তাঁদের সামনে ‘উদাহরণ’ নেই। এরপর সামাজিক-পারিবারিক বাধা তো আছেই।
ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নারীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী এবং একসময়ের বাম ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া মতিয়া চৌধুরী তাঁদের কাছে উদাহরণ। তা ছাড়া ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে এসে জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারকেও তাঁরা উদাহরণ মানেন, তিনি নির্বাচন করে সাংসদও নির্বাচিত হয়েছেন।
কোন ছাত্রসংগঠনে কত নারী: বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গত কয়েকটি কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেগুলোতে নারীদের হার একেবারেই কম। বিগত তিন কমিটির কোনোটিতেই নারীদের সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি ছিল না।
২০১১ সালে বদিউজ্জামান সোহাগ ও সিদ্দিকী নাজমুল আলমের কমিটি ২১৯-২২০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে। ওই কমিটিতে নারী ছিলেন মাত্র ১০ জন, শতকরা হিসাবে যা ৫ শতাংশের কম। ৪১ জন সহসভাপতির মধ্যে নারী ছিলেন একজন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন একজন করে নারী। এর বাইরে পূর্ণাঙ্গ সম্পাদক পদে আর কোনো নারী ছিলেন না। পরবর্তী কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৬১ জন সহসভাপতির মধ্যে ৬ জন নারী থাকলেও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন না কোনো নারী। ২০১৬ সালে সাইফুর রহমান সোহাগ-এস এম জাকির হোসেনের এই কমিটিতে ৩০১ সদস্যের মধ্যে নারী ছিলেন ১৮ জন। শতকরা হিসাবে যা ৬ শতাংশের মতো। চলতি বছরের মে মাসে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও গোলাম রাব্বানী ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেন। সেখানে জায়গা হয় ১৭ জন নারীর। সহসভাপতি পদে ৬১ জনের মধ্যে নারী ছিলেন ৪ জন। সহসাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন একজন করে নারী। তবে এবারও সম্পাদকীয় পদে ছিলেন না কোনো নারী।
ছাত্ররাজনীতিতে নারীদের অবস্থান প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আফরীন নুসরাত বললেন, নিরাপত্তার অভাব ও পরে মূল্যায়িত না হওয়ার আশঙ্কা ছাত্ররাজনীতিতে নারী শিক্ষার্থীদের আসার পথে অন্যতম বাধা। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবেও রাজনীতিতে আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে নারীদের সংখ্যা আরও কম। ২০১৩ সালের আবদুল কাদের ভূঁইয়া ও হাবিবুর রশিদের ২৯১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নারী ছিলেন মাত্র ১০ জন। ৩১ জন সহসভাপতির মধ্যে কোন নারী ছিলেন না। ৫৩ জন সহসাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ৩ জন ছিলেন নারী। ২০১৪ সালে রাজীব আহসান ও আকরামুল হাসানকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে ১৫৩ সদস্যের আংশিক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে নারী ছিলেন ১০ জন। পরবর্তী সময়ে ৭৩৬ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়, সেখানেও নারীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
ছাত্রদল থেকে রাজনীতি করে উঠে আসা বিএনপির বর্তমান কমিটির সহশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক হেলেন জেরিন বললেন, রাজনীতিতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। তা ছাড়া এই পথ মসৃণ নয়। বিয়ে-সংসার-কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর মেয়েরা আর রাজনীতিতে থাকতে চান না। ফলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কিছু কিছু ছাত্রী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেও তাঁদের বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে থাকেন না। তাঁর মতে, ছাত্রসংগঠনে ছাত্রীদের পদ দিতে হবে। তাঁদের সামনে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দলকেই পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ৩৬তম কাউন্সিলে শীর্ষ পদে আসেন একজন নারী। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দেশব্যাপী পরিচিতি পাওয়া লাকি আক্তার নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদক পদে। ২০১৪ সালের ৪১ সদস্যের এই কমিটিতে সমাজকল্যাণ ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক এবং সদস্যপদে ছিলেন আরও দুই নারী। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি ও ২০১৯ সালের এপ্রিলে গঠিত ৪১ সদস্যের কমিটিতে নারীর সংখ্যা ছিল তিনজন করে।
গত বছর ছাত্র ফেডারেশনের সর্বশেষ কাউন্সিলে ২৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী ছিলেন ৪ জন। এর আগে ২০১৪ সালে ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে ২ জন এবং ২০১২ সালের ২৫ সদস্যের কমিটিতে ৪ জন ছিলেন নারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের একজন নেত্রী বললেন, ‘মেয়েদের রাজনীতি করা ছেলেদের চেয়ে অনেক কঠিন। এখানে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছ থেকেও অসহযোগিতা পেতে হয়। রাজনীতির মাঠে শ্রম দিয়ে পদ পাওয়ার পরও অনেকেই নানা ধরনের তির্যক মন্তব্য করতে ছাড়েন না।’