মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার ও সাজা বিতর্ক,
কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে এনে ডিসি অফিসে রাত ২টায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এটি একদিকে যেমন পাবলিক সার্ভেন্ট তথা জনগণের সেবকের অবৈধ ক্ষমতার দাপটের বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত নাগরিক অধিকার, ফৌজদারি আইন এমনকি যে আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন ও পরিচালিত হয়, তারও চরম লঙ্ঘন। সর্বোপরি আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। বিচারের নামে কেন এমন প্রহসন? দশম সংসদের কুড়িগ্রাম-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার অনুকূলে টিআর কাবিখা’র বরাদ্দ থেকে কুড়িগ্রামে শহরে একটি পুকুর সংস্কার কাজ করা হয়। এতে প্রায় ১০৪ দশমিক ৫৫৫ মেট্রিক টন চাল এবং ২৫টি সোলার স্ট্রিট ল্যাম্প বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া অন্য স্থান থেকে ৩১টি সোলার স্ট্রিট ল্যাম্পের বরাদ্দ কেটে এই পুকুর পাড়ে স্থাপন করা হয়। এছাড়া জেলার কিছু ব্যক্তি অনুদানও দেন। গত বছরের ১৪ মে জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তার ছবিসহ পুকুরের পুরনো নাম ‘নিউ টাউন পার্ক’ পাল্টে নতুন নাম (সুলতানা সরোবর) সংবলিত একটি পোস্ট দেন। আরিফ ‘কাবিখার টাকায় পুকুর সংস্কার করে ডিসির নামে নামকরণ!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে, যা বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশ হয়। এছাড়া সম্প্রতি আরও কিছু অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবেদন নিয়ে কাজ অব্যাহত রাখায় বেশ কয়েকবার তাকে ডিসি অফিসে ডেকে নেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে প্রতিশোধ নিতেই মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচার ও সাজা। অবশ্য জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন মধ্যরাতে ধরে এনে সাজা দেওয়াকে ‘আইন মেনেই করা’ হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
ভ্রাম্যমাণ আদালতে আরিফের বিচার ও সাজার পূর্বাপর ঘটনা বেশকিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—এক. জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেছেন, ‘কুড়িগ্রাম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুরোধে আমার কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে পুলিশের ছয় জন, আনসারের পাঁচ জন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তিন জন সদস্য মিলে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বাসায় মোবাইল কোর্টের অভিযানে গেছে। কুড়িগ্রাম জেলার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আবু জাফর বলেছেন, লালমনিরহাটে মাদক মামলার এক আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কুড়িগ্রামে এদিন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কোনও আদালত পরিচালনা করেননি। অভিযানও চালাননি। জেলা প্রশাসনকে আমরা কোনও বিষয়ে অনুরোধও জানাইনি। টাস্কফোর্সের বিষয়ও জানতাম না। শনিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন পরিদর্শক আমাকে জানান, রাতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছিল। সেখানে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে আমাদের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ অন্য বাহিনীর সদস্যদের যুক্ত করা হয়। অন্যদিকে, কুড়িগ্রাম সদর সার্কেলের দায়িত্বে থাকা সহকারী পুলিশ সুপার উৎপল রায় বলেন, ‘আরিফুল ইসলাম রিগানের মোবাইল কল পেয়ে আমরা দ্রুত তার বাড়িতে ছুটে যাই। আমরা গিয়ে দেখি, বাড়ির গেট ও বাসার গেট ভেঙে ঢুকে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তাকে ট্রেস করার জন্য চারদিকে পুলিশের মোবাইল টিমকে আমরা বলি। রংপুর র্যাব-১৩ ও লালমনিরহাট পুলিশকে অবহিত করা হয়। কারণ বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ছিল। আমাদের আশঙ্কাও ছিল। আমরা খুঁজতে খুঁজতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সামনে দুটি গাড়ি দেখতে পেয়ে সেখানে যাই। তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা হয়। কথা বলে জানতে পারি, আরিফুল ইসলামকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তার অপরাধ কী জানতে চাইলে তারা জানায়, দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা ও অর্ধেক বোতল মদ পাওয়া গেছে। পরে আমরা সেখান থেকে চলে আসি।’
জেলা প্রশাসক অফিস, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও সহকারী পুলিশ সুপারের বক্তব্য থেকে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, কেউ একজন অসত্য বলছেন। তিনি কে এবং কেন অসত্য বলছেন? আরিফের অন্যায় সাজা বৈধ করার জন্য কী? দুই. কুড়িগ্রাম পৌর মেয়র আবদুল জলিল জানান, নিয়মানুযায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে মেয়রের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তাকে কিছু অবহিত করা হয়নি। এএসপি উৎপল রায় বলেছেন, ‘ডিসি অফিস মোবাইল টিম বা টাস্কফোর্স করার জন্য চিঠি দিয়ে থাকে। সেই আলোকে আমরা নিয়মিত পুলিশ দিয়ে থাকি। কিন্তু এই ঘটনা সম্পর্কে আমাদের সিনিয়র কেউই কোনও কিছু জানতেন না।’ আরিফের বাসায় অভিযান এই গোপনীয়তা ও লুকোচুরি কেন? গোপনীয়তা না থাকলে মধ্যরাতে অবৈধ অভিযান পরিচালনা করে আরিফকে সাজা দেওয়া যেতো না সেজন্য কী? তিন. আরিফ কী ভয়ংকর অপরাধী বা তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী যে গভীর রাতে তার বাড়ির গেট ও দরজা ভেঙে প্রবেশ করে তাকে আটক করতে হলো, রাতেই আদালত বসিয়ে বিচার করতে হলো? সহকারী পুলিশ সুপারের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘কুড়িগ্রাম সদর থানায় আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনও জিডি, অভিযোগ কিংবা কোনও মামলা নেই। ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমরা একজন ভালো মানুষ হিসেবে চিনি ও জানি। কিন্তু কেন এমন হয়েছে, তা আমরা বুঝতে পারছি না।’ কুড়িগ্রাম পৌর মেয়র আবদুল জলিলও বলেছেন, ‘সাংবাদিক আরিফ তার জানা মতে কোনও অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত নয়। তাকে অধূমপায়ী মানুষ হিসেবে চেনেন বলেও জানান মেয়র।’ কুখ্যাত ও তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের কার বাসায় মধ্যরাতে দরজা ভেঙে ভ্রাম্যমাণ আদালত ইতোপূর্বে অভিযান পরিচালনা ও রাতের আদালতে সাজা দিয়েছেন, সে দৃষ্টান্ত আছে কি? তাহলে আরিফের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন হলো, এর পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য ও কারও নির্দেশনা কাজ করেছে কি? চার. বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে।’ আরিফ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের জন্য কী হুমকি সৃষ্টি করেছিল যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কর্তৃক তার নাগরিককে দেওয়া সাংবিধানিক নিশ্চয়তা কেড়ে নেওয়া হলো। পাঁচ. মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে—ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ধারা ১১ এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করিবার সময় তফসিলে বর্ণিত আইনের অধীন কোনও অপরাধ, যাহা কেবল জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য, তাহার সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হইয়া থাকিলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, দোষী সাব্যস্ত করিয়া, এই আইনের নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করিতে পারিবেন। ঘটনাস্থলে বিচারের সুস্পষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বেও আরিফের বিচার ঘটনাস্থলে না করে কেন ডিসি অফিসে আদালত বসানো হলো? মাদক বিষয়ে আরিফের কী অপরাধ ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হয়েছিল—সেবন না ব্যবসার উদ্দেশ্যে দখলে রাখা। মোবাইল কোর্ট আইনের ৬ (৪) ধারায় বর্ণিত হয়েছে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করিবার সময় যদি অনুরূপ কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট এইরূপ মনে হয় যে, অপরাধ স্বীকারকারী ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট অপরাধ এমন গুরুতর যে, এই আইনের অধীন নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করা হইলে উহা যথোপযুক্ত দণ্ডারোপ হইবে না, তাহা হইলে তিনি উক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড আরোপ না করিয়া তাহার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়েরের ব্যবস্থা করিবেন।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এ বলা আছে, অ্যালকোহল ছাড়া অন্যান্য মাদকদ্রব্যের উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহার হয়, এমন কোনও দ্রব্য বা উদ্ভিদের চাষাবাদ, উৎপাদন, বহন, পরিবহন বা আমদানি-রফতানি, সরবরাহ, বিপণন, গুদামজাত, সেবন বা ব্যবহার, অর্থ বিনিয়োগ বা পৃষ্ঠপোষকতা করা যাবে না। এতে আরও বলা হয়েছে—কোনও ব্যক্তি আইনের এই বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আরিফের কাছে তো মদ ছাড়াও অন্য মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে। এটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক দণ্ড আরোপ না করে তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়েরের ব্যবস্থা কেন করা হলো না? পাঁচ. গৃহ তল্লাশি ও মালামাল জব্দের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ বিধিতে (পিআরবি) গৃহ তল্লাশির আগে, তল্লাশির সময় ও তল্লাশির পর আবশ্যিক পালনীয় কিছু বিধি রয়েছে। ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনও ব্যক্তি ফৌজদারি মামলার সংশ্লিষ্ট আলামত, বস্তুসাক্ষ্য, অপহৃত ব্যক্তি, দলিল ও চোরাই মালামাল উদ্ধারের জন্য পরোয়ানাসহ অথবা পরোয়ানা ছাড়া গৃহে যে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে গৃহ তল্লাশি বলে। গৃহ তল্লাশির আগে পালনীয় নিয়মাবলি হলো—গৃহটি সশস্ত্র পুলিশ দ্বারা ঘিরে রাখতে হবে, আশপাশের ২/৩ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে ডাকতে হবে, গৃহের মালিকের অনুমতি নিতে হবে, সাক্ষীর এবং তল্লাশিকারীর নিজের শরীর বাড়ির মালিক দ্বারা তল্লাশি করাতে হবে, পোশাক পরিহিত অবস্থায় থাকতে হবে। গৃহ তল্লাশির সময় যেসব নিয়ম পালন করতে হবে—গৃহের মালিক এবং সাক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে তল্লাশি পরিচালনা করতে হবে, পরোয়ানায় উল্লিখিত স্থান ছাড়া অন্যত্র তল্লাশি করা যাবে না, তল্লাশিকৃত মালামাল ছাড়া অন্য কোনও মালামাল হস্তগত করা যাবে না, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দেহ তল্লাশি করতে হবে, তল্লাশির সময় কাউকে অযথা হয়রানি করা যাবে না। গৃহ তল্লাশির পরের নিয়মাবলি হলো—উদ্ধারকৃত মালামালের জব্দ তালিকা প্রস্তুত করত: সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিতে হবে, জব্দকৃত মালামালের গায়ে লেবেল লাগাতে হবে এবং সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিতে হবে, জব্দ তালিকা এক কপি বাড়ির মালিককে দিতে হবে, তল্লাশি করে কোনও মালামাল পাওয়া না গেলে একটি শূন্য প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে এবং সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিতে হবে, তল্লাশির ফলাফল জিডিতে নোট দিতে, জব্দ তালিকার মূল কপি প্রয়োজনমতো আদালতে পাঠাতে হবে। আরিফের গৃহ তল্লাশি মাদক জব্দ করার ক্ষেত্রে এসব নিয়ম কেন পালন করা হয়নি? পরিবারে অন্য কোনও পুরুষ মানুষের অনুপস্থিতিতে, প্রতিবেশীকে সাক্ষী না করে জেলা প্রশাসকের অফিসে তুলে আনা, নিয়ম পালন না করে মাদক উদ্ধার ও তার ভিত্তিতে সাজাদান বৈধ হবে কী? ছয়. মোবাইল কোর্ট আইনের এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধির অধীন সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত, কোনও কার্যের জন্য কোনও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইলে তিনি মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সহিত সংশ্লিষ্ট অন্য কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনও দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনও প্রকার আইনগত কার্যধারা রুজু করিতে পারিবেন না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোনও স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনও ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ নিশ্চয়তা প্রদান করেছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোনও ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ মধ্যরাতে দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে আরিফকে তুলে নিয়ে ঘটনাস্থলে বিচার না করে সাজা প্রদান কি সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত হবে? তা না হলে আরিফের স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানির কী হবে? সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে তার কী হবে? সাত. জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ‘ওই সাংবাদিককে (আরিফ) নিয়ে মোবাইল কোর্ট করার আমার কোনও ঠেকা পড়েনি।’ জেলা প্রশাসকের এহেন উক্তিতেই আরিফের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর তাকে দায়িত্বে রেখে কী নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব?
গভীর রাতে মানুষকে ধরে এনে সাজা দিয়ে জেলে পাঠানো এটা কোনও সভ্য দেশের বিচার হতে পারে না। শিশু আইনে স্পষ্টই বলা আছে, অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, অপরাধে জড়িত থাকা শিশুর বিচার শুধু শিশু আদালতেই হবে। অথচ ভ্রাম্যমাণ আদালত শিশুদের দণ্ড দিয়েছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে পর্যটকের চুল কেটে দেওয়া হচ্ছে। এবার মোবাইল কোর্ট আইনের বিধান লঙ্ঘন করে ঘটনাস্থলে বিচার না করে ভিন্ন জায়গায় গভীর রাতে আদালত বসিয়ে সাংবাদিকের বিচার করা ও সাজা দেওয়া হলো। একের পর এক বিতর্কে জড়াচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ ধরনের ক্ষমতার দাপট সরকার ও প্রশাসনের ওপর জনগণের আস্থা কমায় এবং পরিস্থিতি বিরূপ করে তোলে। নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের সাজা দিতে হবে আইনের শাসন, সুশাসন, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার স্বার্থেই। মুজিব বর্ষে এর ব্যত্যয় হলে মুজিব বর্ষের লক্ষ ও উদ্দেশ্য হোঁচট খাবে বৈ কি।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।