লেখকঃ সবুজ আহমেদ, পাঠক, ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, অধ্যক্ষ, দ্যা নিউ স্কুল ঢাকা
‘পাখিদের মিছিলে একজন হব,
ডানায় ভর করে উড়ুক্কু এক আমি সবার আগে
জেনে নেব পৃথিবীর ভাষা।‘
পাখির ডানায় ভর করে পৃথিবীর ভাষা জেনে নেবার প্রত্যাশায় বাংলা কবিতার ভূবনে পদার্পণ কবি জহরত আরার। অধ্যাপক জহরত আরার ষাটটি কবিতা নিয়ে ‘পাখিদের মিছিলে’ বইটি ঢাকা বইমেলায় এসেছে ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ এ। প্রকাশকঃ অচিন্ত্য চয়ন, দেশ পাবলিকেশন্স। অনিন্দ-সুন্দর চাররঙ্গা প্রচ্ছদের শিল্পী হলেন মিনতি রায়। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। বই মেলার মূল্য ১৫০ টাকা। ISBN-97898494712-4-0।ঢাকা বইমেলায় বইটি পাওয়া যাচ্ছে ২৫৩ ও ২৫৪ নম্বর স্টলে এবং চট্টগ্রাম বইমেলায় ১০২ নম্বর স্টলে।অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে www.rokomari.com/desh এ।
কবি জহরত আরার লেখালেখির অভ্যেস ছোটবেলা থেকেই।তবে তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা প্রয়াত লেখক আহমেদ ছফা,যাকে কবি কাছ থেকে দেখেছেন, স্নেহধন্য হয়েছেন। তাই ‘পাখিদের মিছিলে’ তিনি উৎসর্গ করেছেন তার প্রিয় লেখক ও মেন্টর আহমেদ ছফাকে। উৎসর্গে কবি বলেছেন, ‘যার মহান সান্নিধ্য আমাকে বিকশিত করেছে, প্রতিনিয়ত উন্নত মানুষ হবার প্রক্রিয়াটি যিনি শিখিয়েছেন,দীর্ঘ প্রয়াত সেই মহাত্মা’র স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
বইটি বাজারে এসেই ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রথম পাঠকদের মধ্যে আছেন দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছেন এমন অনেক কবি, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক। তারা পছন্দ করেছেন এ সংকলনের কবিতাগুলো। পড়তে বলেছেন অন্যদের। এর মূল কারণ প্রত্যেকটি কবিতায় আছে কবির নিজস্বতার ছাপ।সাহিত্যে দীর্ঘদিনের পড়াশোনা,অনভূতিশীল মন, সহজ-সুন্দর বাংলা ভাষার গাঁথুনি এবং স্বতন্ত্র দেখার চোখ-সব মিলে তৈরি হয়েছে তার অনবদ্য রচনাশৈলী।
সংকলনের প্রথম কবিতা ‘অনুভবে অস্তিত্ব’। মনোরম বেশ কিছু শব্দচিত্র দিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তার অস্তিত্বের অবয়ব। ‘শরতের পেঁজা পেঁজা তুলো মেঘ’ আপনাকে সাথে করে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, ‘মেঘ ছুঁতেই’ ঝরবে বৃষ্টি। ‘ঝুর ঝুর’ শিউলি ভরে দেবে মাঠ, ভরে দেবে ‘অলস সন্ধ্যার অগোছালো আঁচল’। ‘আষাঢ়ের রাগিণী’ ছন্দে ছন্দে মাতিয়ে দেবে আপনার মন। প্রকৃতি প্রেম অবশেষে আপনাকে ‘শিক্ত’ করবে রোমান্টিক প্রেমের ছোঁয়ায়।
আমার আরেকটি প্রিয় কবিতা ‘এক বাক্স অন্ধকার’, সূচিপত্রের পঞ্চম কবিতা। পুরো কবিতাটি তৈরি হয়েছে ‘এক বাক্স অন্ধকার’ এই রূপকটির উপর।‘অন্ধকার দিয়ে কবি তৈরি করেছেন বিনির্মাণের শূন্যতা’।কবি তৈরি করেছেন সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে মেতে ওঠার এক জগত। পুরাতনকে ভুলে-ভেঙ্গে-মুছে নতুনের আবাহনের প্রস্তুতি এ কবিতার উপজীব্য। কবির ভাষায় এ ‘শীতল অন্ধকার!’ যেখানে ‘কোন শব্দ নেই, ভাষা নেই, যেখানে ‘ব্যাক্তি বা বস্তুর অনুশাসন নেই’। আছে ‘নৈশব্দ’, যে নৈশব্দ আলিঙ্গন করবে আপনাকে, আপনি আপ্লুত হবেন ‘অন্ধকার মাখা আবেগে’।
‘অবশেষে কাশবনে…’ কবিতায় আমরা পাই নাগরিক ব্যস্ততায় ব্যাতিব্যস্ত কবির প্রকৃতির কাছে পালাবার আকুতি। কবি ‘ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ফেলে দিয়ে’ প্রকৃতির কাছে আমাদের ‘বেহিসেবি হৃদয় মেলে’ দিতে আহবান জানান। যেখানে প্রকৃতি আমাদের কাশবনের ‘শুভ্রতার মুগ্ধতায় রুদ্ধবাক’ করে দেবে। ‘নরম’ কাশবন ‘ছুঁয়ে’ দেবে আমাদের শরীর।বাতাস খেলবে কাশবনে, ‘বাতাসের ঢেউ’-এ আমরা ‘অভিকর্ষণ ভুলে’ দুলে উঠবো। নাগরিক জীবন আমাদের যে আমিকে চুরি করে নিয়ে গ্যাছে-প্রকৃতির কাছে খুঁজে পাবো ‘হারানো নিজেকে’। অবশেষে কবির চাওয়া-‘ফিরতে চাইনি অভ্যস্ত হিসেবী গণ্ডীতে’, যা পাঠককেও বিষণ্ণ করে দেবে আমাদের ‘অভ্যস্ত’ হেসেবী যাপিত জীবন নিয়ে।
‘হারাতে হারাতে আমি’ মাত্র ১২ আইনের একটি নিটোল লিরিক,যা শেষ হয় কাব্যিক বিষণ্নতায়। কবির হারিয়ে ফেলার তালিকায় ‘রঙ্গিন বেলুল, খেলার মার্বেল, কাঁচের চুড়ি, পায়েল’ যেমন থাকে, তেমনি থাকে ‘হাস্নাহেনার মদির করা ঘ্রাণ, দোলনচাঁপায়, রক্তজবায় চুইয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু জল’। একটু একটু করে হারিয়ে যায় আমাদের ‘স্বাধীনতা’, আমাদের ‘কাছের মানুষ’। উপসংহার নাড়া দেয় আমাদের অস্তিত্বেঃ
‘…হারিয়ে যাচ্ছি আমি
নিজেও নিজের কাছ থেকে রোজ-ই”
কবি আমাদের জন্য এক ইউ্টোপিয়া তৈরি করেছেন তার ‘চিরসুখের দ্বীপে’ কবিতায়—যেখানে ‘বার্ধক্যের কোন স্থান নেই’, ‘গাছ,পাখি,মাছ’ সবসময় ‘তারুন্যের উৎসবে আচ্ছন্ন’। এ চিরসুখের দ্বীপে ‘পূজো হয় ভালোবাসার’, তারুন্য সেখানে ‘গতিময়, প্রজ্বলিত শিখা অনির্বাণ’।কবির সাথে আমরা পাঠকরাও ‘সমুদ্র পাড়ি দিয়ে’ চলে যেতে পারবো সে ‘চিরসুখের দ্বীপে’।
‘পাখিদের মিছিলে’ কাব্যগ্রন্থের এক বিষণ্ণ-সুন্দর কবিতা ‘প্রেমহীন সন্ধ্যায় তুমি আর আমি’। T.S. Eliott এর ‘The Love Song of J. Alfred Prufrock’ কবিতার ছায়া অবলম্বনে রচিত এ কবিতাটি কবির হাতে মৌলিক হয়ে উঠেছে।কবিতার শুরুতে ভালোবাসার মানুষকে কবি আহবান করছেন এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় তার সাথে বেড়াতে যেতে। নাগরিক জীবনযুদ্ধে অস্থির নর-নারীর ভালোবাসাহীন জীবন অপূর্ব কাব্যিক দক্ষতায় কবি তুলে এনেছেন এ কবিতায়। প্রথম উপমাটিই ঠিক করে দিচ্ছে কবিতার মূল সুর।
‘এই ক্লান্ত সন্ধ্যায়,যখন সন্ধ্যা আকাশের গায়ে এলিয়ে দিচ্ছে তার পিঠটি,
যেন ক্লোরোফরম নিয়ে অচেতন কোন রোগী শুয়ে আছে অপারেশন টেবিলে’।
আবেগহীন, অর্থহীন,গন্তব্যহীন জীবনকে পাশ কাটাতে কবি খোঁজেন ‘টঙ্গের দোকান,যদি পাই এক ফালি লেবু কাটা চা’। ‘হলুদ ধোঁয়া’, ‘ধুলো ওড়া আমাদের এই পথ’, ‘শীসেয় ঢাকা শহর’, ‘মনের নিরব যুদ্ধ’-তৈরি করে এক বিষণ্ণ আবহ। আর এ অমিমাংসিত বিষণ্ণতায় শেষ হয় এন্টি-রোমান্টিক কবিতাটি।এ বিষণ্ণতার রেশ রয়ে যায় অনেকক্ষণ।
শিরোনামের কবিতা ‘পাখিদের মিছিলে’। মাত্র ১১ লাইন। এই ছোট্ট পরিসরে কবি নিদারুন নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলেছেন তার অন্ধকার থেকে আলোকে যাবার আকুতি, রাত পাড়ি দিয়ে ভোরের আভাসে ‘পাখিদের কুহুতান’ শুনতে পাওয়ার আকুতি । এ কাব্যগ্রন্থের মূল ভাবনা এটাই।তাই শিরোনামে জায়গা পেয়েছে কবিতাটি। ‘মানুষ মানুষ খেলায় ক্লান্ত কবি ‘পাখিদের মিছিলে সামিল হতে’ চেয়েছেন। চেয়েছেন পাখিদের মত করে পৃথিবীকে জানতে, চিনতে। কবিতাটি পড়তে পড়তে আমাদেরও মনে হবে ‘ডানায় ভর করে উড়ুক্কু এক আমি’ যোগ দে