প্রত্যাবর্তিত একজন
শীতের রাত। যখন আমার বয়স প্রায় পাঁচ বছর। এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় আমার বাবা মারা যান। বাড়িস্থ সবাই সৃষ্টিকর্তার সেই ফয়সালা সহজে মানতে ইচ্ছুক ছিল না। জীবন সম্পর্কে আমার মোটেই ধারণা ছিল না। কিন্তু সে সময়ের স্মৃতিগুলো আমার এখনো পরিষ্কার মনে আছে। এক মুশরিক পরিবারে আমার জন্ম। দেখতাম মানুষ যখন মারা যায়, সবাই চিৎকার করে বিলাপের সুরে কান্নাকাটি করে। এরূপ তিন দিন পর্যন্ত চলে। তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। যার জন্য ভূমিকাটি অবতীর্ণ করলাম তার মূল কারণ- আমার পিতার অন্তোষ্ট্যিক্রিয়া (শবদাহ) অনুষ্ঠান।
কিছুক্ষণ পূর্বেই যে লোকটি আমার জন্মদাতা বাবা ছিল। মারা যাবার সাথে সাথে সবাই বলাবলি করছিল- আমার বাবা নেই। কিন্তু তার নিথর দেহতো শুয়ে আছে, তবুও নেই বলে কেন? তাহলে কি দেহটা বাবা না? তার যে আত্মা তা-ই বাবা! কিছুই বুঝতাম না। আমিও অন্যদের মতো আমার বাবাকে এনে দাও, আমার বাবাকে এনে দাও… এরূপ চিৎকার করে করে কান্না করছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি-কিছু কাঠুরিয়া আসল। তারা দেখি গাছ কেটে পুকুর পাড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কেন যে গাছ কাটাকাটি শুরু হলো, কিছুই আমি বুঝতে পারছিলাম না। অনেক আত্মীয়-স্বজন আসল। যখন নতুন একজন আত্মীয় আসত, তার সাথে সাথে বাকি সবাই কান্নার তীব্রতা বাড়িয়ে সুরে সুরে কাঁদত। পরবর্তীতে জানলাম- এরূপ না কাঁদলে নাকি স্বর্গে যাওয়া হবে না আমার সদ্যপ্রয়াত পিতার। তাদের ভুল ধারণা ছিল, মানুষ ভাল কাজ করলে স্বর্গে যায় এবং খারাপ কাজ করলে নরকে যায়। তাদের মতে, স্বর্গভোগ কিংবা নরকভোগ ক্ষণস্থায়ী। ভোগ শেষে আবার দুনিয়ায় ফিরে আসতে হয়। তারা বলে, স্বর্গভোগ শেষে মানুষ আবার পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্ম নেয় এবং নরকভোগ শেষে মানুষ আর মানুষ হিসেবে জন্ম নেয় না, নিম্ন শ্রেণির প্রাণিরূপে জন্ম নেয়।
আমার প্রশ্ন, যদি এরূপ হতো তাহলে দিন দিন মানুষের খারাপ কাজ অর্থাৎ পাপ করার প্রবণতা বেড়েই চলেছে, তাহলে তো মানুষ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু পৃথিবীর মানুষতো দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাহলে কি তাদের কথা ঠিক হলো? এটা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে।
যে কথা বলছিলাম, অত:পর কীর্তন (বাদ্যযন্ত্র সহকারে বিশেষ ধরনের গান) করার লোক আসল। তারা তাদের দেবতার নাম বলে বলে ধ্বনি দিচ্ছিল এবং গান বাজনা শুরু করে দিল। তারা কিছুক্ষণ পর পর আমার বাবার নাম বলে “অমুখ স্বর্গ পেয়েছেন” বলে ঘোষণা দিচ্ছিল। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না- উনারা কীরূপে জানল, আমার বাবা স্বর্গ পেলেন! হঠাৎ দেখি, একজন লোক এসে আমার বাবার পায়ের গিরা দু’টি ভেঙে দিল। তারপর কিছু লোক আমার বাবার নিথর দেহটি পুকুর পাড়ে নিয়ে গেল। পুকুরের হিম শীতল পানি ঢেলে, তেল এবং সাবান দিয়ে পরিষ্কার করছিল আমার বাবার দেহ। বাড়ির মেয়েরাই দেখি আমার বাবার দেহ সাফ করছিল। উন্মুক্ত জায়গায় তার স্নান সারছিলেন, যা আমি তখন ভালো কি খারাপ বুঝিনি। হাই স্কুলে পড়া অবস্থায় মুসলমান বন্ধুদের বাড়িতে মৃত ব্যক্তির গোসল, দাফন-কাফন অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার মস্তিষ্ক বিশাল ভাবনায় পড়ে গেল। ইসলাম ধর্মে মৃতব্যক্তির সাথে ভালো আচরণের নমুনা আমাকে মুগ্ধ করল।
যে কথা বলছিলাম, আমার বাবাকে দাহ (অর্থাৎ পোড়ানো) করার জন্য চিতা সাজানো হলো। কাঠের উপর আমার বাবাকে রাখা হলো অত্যন্ত অনাদরে-অবহেলায় অর্থাৎ যত তাড়াতাড়ি পোড়ানো যাবে ভালো। সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিল, যে ঠোঁট দিয়ে আমার বাবা আমাকে চুমু খেতেন, সেই প্রিয় বাবার প্রিয় ঠোঁটটিতে আমার মতো এক শিশুকে দিয়ে আগুন লাগানো হলো এবং তার চিতায় কেরোসিন তেল ও ধূপ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো। আমি ছোট ছিলাম, তারপরও আমাকে আমার বাবাকে পোড়ানোর দৃশ্য অবলোকন করতে হলো। এটাই নাকি নিয়ম! কিছুক্ষণ পর বাবার শরীরটা নড়েচড়ে উঠল। আগুনে শরীরের কোষের অভ্যন্তরের তরল পদার্থ ও চর্বিসমূহ ফোঁটা ফোঁটা গলতে শুরু করল, কীরূপ বিশ্রী এক গন্ধ ছড়াচ্ছে পরিবেশে। শবদাহকারী লোকেরা বাঁশ দিয়ে আমার বাবার শরীরের উপর আঘাত করছিল এবং বাবার শরীর ছিদ্র করে দিচ্ছিল। কী দু:সহ সেই স্মৃতি!
একটা সময় আমার চোখে কান্নার আর রেশ থাকল না, অবাক বিস্ময়ে কী ঘটতে যাচ্ছে, আমি শুধু তা দেখতে উদগ্রীব হয়ে ছিলাম।আমার বাবাকে পুড়িয়ে নি:শেষ করতে তাদের প্রায় তিন ঘন্টার মতো সময় লাগল। তাদের চোখে মুখে যে কী তৃপ্তি! আমার বাবার মৃত দেহের সৎকার করতে গিয়ে তাদের দারুণ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল; কারণ বাবার দেহটি নাকি সহজে পোড়া যাচ্ছিল না। আমাদের মতো ছোট শিশু থাকাতে নাকি উনার বুক পোড়া যাচ্ছিল না। আহা! কী দু:সহ স্মৃতি! ও একটা কথা বলা হলো না, আমার বাবার শরীর অর্ধেকটা পোড়ানো অবস্থায় বাবার চেয়ে বয়সে ছোট ছেলেরা এক বিঘত পরিমাণ আম কাঠ নিয়ে বাবার জ¦লন্ত চিতার সামনে পর্যায়ক্রমে গিয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে কাঠ চিতায় দিচ্ছিল। আমাকেও কাঠ নিয়ে বাবার জ¦লন্ত চিতায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমিও মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে জ¦লন্ত চিতায় প্রণাম করে বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে কাঠ চিতায় দিলাম। আমি বাবার পা থেকে জ¦লন্ত চিতায় মাংস খসে পড়তে দেখলাম; যার কারণে আমি প্রায় দুই বছর অসুস্থ ছিলাম। প্রতি রাতে আমি ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠতাম।
আমার মাকে আমি প্রায় সময় জিজ্ঞেস করতাম, “সবার বাবা শহর থেকে বাড়িতে আসে, আমার বাবা আসে না কেন?” কী করে বুঝাবে আমার মা, মা আমাকে জড়িয়ে ধরতেন, তাঁর উষ্ণ অশ্রু ধারায় আমার মুখমন্ডল সিক্ত হয়ে যেত। হাইস্কুলে পড়াবস্থায় মৃতদেহ পোড়ানোর বিষয়ে চিতাখোলায় (মৃতদেহ দাহ করার স্থান) আমি বেশ প্রতিবাদ করতাম। তারা আমাকে ভুলভাবে অনেক কিছু বুঝাতো তার কয়েকটি নমুনা নি¤েœ শেয়ার করছি; যা আমাকে পরবর্তীতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসতে সহায়তা করেছে। তাদের সে শিক্ষাসমূহ এবং আমার মুশরিক থাকাবস্থার ভাবনা আমি নি¤েœ পেশ করছি:
শিক্ষা (১): আমরা পোশাক পরিধান করি, পুরাতন ও নষ্ট হলে ফেলে দিই। আত্মাও সেরূপ দেহ ধারণ করে আবার দেহ ত্যাগ করে। তাই দেহের কোনো মূল্য নেই। আত্মার কোনো মৃত্যু নেই। আত্মা অবিনশ্বর।
ভাবনা: যদি দেহের কোনো মূল্য না থাকে, তাহলে মুশরিকদের সাধু সন্যাসী ও বিত্তবান মানুষদের পোড়ানো হয় না কেন? সমাধি দেয় কেন? দেহের কোনো মূল্য না থাকলে সমাধি কিংবা পোড়ানোর প্রয়োজন কী? এ কথা চিন্তা করে একবার আমি আমার দেহ মৃত্যুর পরে মেডিকেলে দান করার অঙ্গীকার করতে গিয়েছিলাম!
শিক্ষা (২): মানবদেহ দাহ করা বিজ্ঞানসম্মত, আগুনে পুড়লে জীবাণু ধবংস হয়। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন থাকে।
ভাবনা: কী কপাল পোড়া! কোথায় গেল মানবিকতা! বিজ্ঞানের অজুহাত দিয়ে কি নিজ মা, বাবা, আত্মীয়দের আগুনে পোড়ানো যাবে!
শিক্ষা (৩): সব মানুষের আত্মা পরমাত্মার অংশ। পরমাত্মা মানে সৃষ্টিকর্তা। বার বার দুনিয়াতে জন্ম নেয়ার পর আত্মা মুক্তি লাভ করে। মুক্তি লাভ করার জন্য প্রত্যেক প্রাণীর দেহধারণ করতে হয়, অবশেষে মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়। দুর্লভ মানবজীবন লাভ করে অবশেষে পরমাত্মার সাথে মিলিত হয় অর্থাৎ মুক্তি লাভ করে।
ভাবনা: আত্মা যদি পরমাত্মার অংশ হয় তাহলে সব প্রাণী উন্নত শ্রেণির প্রাণী হিসাবে জন্ম নিতে পারত। অ্যামিবা, হাইড্রা, গুণগুণি পোকা, ছারপোকা, কুকুর, শকুন ইত্যাদি হিসেবে জন্ম নিত না। আমরা সবাই সৃষ্টির সেরা মানুষ হতে পারতাম।
শিক্ষা (৪): আমরা অগ্নি উপাসক, সারাটা জীবন অগ্নির পূজা করি, তাই অগ্নির সাথে মিশে যাওয়ার বাসনা আমাদের থাকা চাই। তাই মৃতদেহ সৎকার অর্থাৎ দাহ করা হয়।
ভাবনা: দুনিয়াতে কোনো একজন যদি কোনো লোকের গোলামী করে, তাহলে সে মালিক কি গোলামকে নি:শেষ করে দিতে পারে! তার আগুনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করার কথা, যেভাবে আমরা বাতাসে হাঁটা-চলা করি!
এভাবে তাদের সাথে উল্টাপাল্টা জীবনযাপন করতে করতে একটা সময় আমার মনে প্রচন্ডভাবে ভাবনা শুরু হয়ে গেল এবং প্রতিনিয়ত দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি দিনাতিপাত করতে লাগলাম। আর আমি চিন্তার সাগরে অবগাহন করতে লাগলাম- “অন্ধকার কী, তা যদি না বুঝি,
আলোর উপস্থিতি বুঝিব কেমনে?
মূর্খতা কী, তা যদি না জানি,
জ্ঞানের দীপ্ত প্রকাশ কীরূপে চিনি।
আল্লাহর একত্ববাদ না বুঝিলে,
শিরক বুঝিব কোন ছলে।
বিদ্যালয়ের এক মুসলিম শিক্ষক
বলেছিলেন মোদের,
ইবাদতের জন্য সৃষ্টি মানুষের।
আল্লাহর বিধান মানাই ইবাদত,
পূজার বিপরীতটাই ইবাদত।
আল্লাহকে যে রূপে জানি,
অন্যদের সে রূপে জানাই শিরক।
শিরক বড় ভয়ংকর,
হবে না সে পাপ মার্জনা।
সময় থাকতে না বুঝিলে,
কিছুতে পার পাবো না।
মাথানত শুধু আল্লাহর কাছে,
যা বলুক মোরে লোকে পাছে।
মুশরিক থাকাকালে কত দোয়া,
করেছি আল্লাহর কাছে,
কেমনে ভাঙ্গিব শিরকের বৃত্ত,
রয়েছে যা মোর চারপাশে।”
যে কথা বলছিলাম- আমার মায়ের কাছে বাবার শহর থেকে গ্রামে আসছে না কেন, তা বার বার জিজ্ঞেস করতাম। জ¦লন্ত চিতায় পুড়িয়ে নি:শেষ করার পরও প্রায় পাঁচ বছরের মতো এ ছেলে কীভাবে অনুধাবন করবে যে, তার বাবা ফিরে আসবে না। মা আমার, মিথ্যে আশ^াস দিতেন, প্রতি রাতে। একটা সময় আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। কয়েকদিন পর আমরা আবার বাবাকে যেখানে দাহ করা হয়েছে, সেই চিতায় গেলাম। কিছু মানুষ বাবার চিতা থেকে ভস্ম (ছাই) সমূহ তুলে নিচ্ছিল এবং একজন দেখি কিছু পোড়া অস্থি সংগ্রহ করছিল। পরে জানলাম, অস্থিগুলো গয়ায় (নদী) বিসর্জন দেয়া হবে, বাবার মুক্তির জন্য। বাবার চিতার ভস্মসমূহ চার/পাঁচজন লোক বহন করে আমাদের বাড়ির পাশের ছোট নদীতে ফেলে দিল। বাবার চিতাটি মাটি দিয়ে ভরাট করে বাঁশের ঘেরা দেয়া হলো। আরও দুই/তিন দিন পর দেখি, আমাদের বাড়িতে অনেক অতিথি আসল এবং বিশাল এক পূজা (শ্রাদ্ধানুষ্ঠান) আয়োজন করা হলো। যা করলে নাকি বাবার আত্মার সদগতি হবে। সদগতি মানে কী? তখন আমি বুঝিনি। পরবর্তীতে জানলাম, সদগতি মানে পরমাত্মার (সৃষ্টিকর্তা) সাথে মিলিত হওয়া। কী অদ্ভুদ কথা!
এভাবে এক বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের স্মৃতি থেকে আমার প্রিয় বাবাকে মুছে ফেলার ব্যবস্থা করা হল। সবাই ভুললে কী আর আমি ভুলি! পুরো সিস্টেমটার ব্যাপারে আমার মন সন্দিহান হয়ে গেল। দুনিয়ার মোমবাতির আগুনে আমাদের হাত লাগলে আমরা সাথে সাথে হাত সরিয়ে ফেলি, আর মানুষ কাঠের মতো পুড়ে নি:শেষ করলে কেমন কষ্ট হয়! আমার মুসলমান বন্ধুরা ৫ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আমাকে জানাল, মানুষ মারা গেলে তাদের শরীর বেশি ব্যথা পায়, খুব সাবধানে নড়াচড়া করতে হয়। আরো কত কিছু তারা আমাকে বলল।
কী দু:সহ সে সব দিন রাত্রি!